নাইন ইলেভেনের হামলায় জড়িত ও যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত শত্রুদের জন্য জর্জ ডব্লিউ বুশের নির্দেশে ২০০২ সালে কিউবার দক্ষিণ অংশে ক্যারিবীয় সাগরে গুয়ান্তানামো নৌ ঘাঁটিতে খোলা হয় কুখ্যাত বন্দিশিবির৷ বছরের পর বছর বন্দিদের বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছিল এই কারাগারে। নিষিদ্ধঘোষিত ওয়াটারবোর্ডিং থেকে শুরু করে কুকুরের মুখে ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত হেন নির্যাতন নেই যে, তা চালানো হয়নি বন্দিদের ওপর। শুধু তাই নয়, কীভাবে নির্যাতন চালাতে হয় সেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের অনেক শিক্ষানবীশ গোয়েন্দাকে।
কারাগারের প্রথম যে ইউনিটে বন্দিদের এনে রাখা হয়, সেটি ছিল ক্যাম্প এক্স-রে। ২০০২ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম বন্দিদের নিয়ে আসা হয় এই ক্যাম্পে। কমলা রঙের জাম্পস্যুট পরিহিত শেকলবন্দি কয়েদিদের কুকুরের খাঁচায় আটকে রাখা হতো। এই ছবি প্রকাশের পর তিন মাসের মাথায় ক্যাম্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে নির্যাতন বন্ধ হয়নি, বরং বেড়েছে।
মানবিকতা শব্দটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না গুয়ান্তানামোতে। শেকল দিয়ে বাঁধা বন্দিদের কারাগারে আনার পরই শুরু হতো নির্যাতন। অধিকাংশ বন্দিকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা নগ্ন করে রাখা হতো। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ইলেকট্রিক তার দিয়ে পেটানো, ভাঙা গ্লাস দিয়ে খোঁচানো, জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে পোড়ানো ছিলো নিয়মিত চর্চা।
সোমালি নাগরিক মোহাম্মদ সালেহ বিন বারেকে ২০০১ সালে আটক করা হয় পাকিস্তান থেকে৷ তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আফগানিস্তানে, সেখান থেকে তাকে নেওয়া হয় গুয়ান্তানামোতে। আট বছর কারাগারে থাকা সালেহ বিন বারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দাঁড় করাতে পারেনি মার্কিন কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত ২০০৯ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
সালেহ মুক্তির পর বলেছেন, সেখানে এমন এক বিশেষ পদ্ধতিতে নির্যাতন চালানো হতো, যার ফলাফল হচ্ছে মানসিকভাবে হত্যা করা। দিনের পর দিন তাদের ঘুমাতে দেওয়া হতো না৷ নির্যাতনের সময় বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো৷ বন্দি শিবিরে তার সঙ্গে থাকা বেশ কয়েকজন নির্যাতনে তাদের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, কেউ হারিয়েছেন তাদের হাত বা পা, কেউ মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে গেছেন।
শিবিরের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ২০০৪ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, ক্যাম্প এক্স-রে শিবিরে বন্দিদের পশুর মতো খাঁচার ভিতরে রাখা হত৷ নগ্ন করে ফেলা হতো বন্দিদের। হাত-পা মেঝের সঙ্গে লাগানো বল্টুতে বাঁধা অবস্থায় তাদের চেয়ারে বসতে হয়েছে৷ ১৪ ঘন্টা ধরে বন্দিদের চোখ-ধাঁধানো ফ্লাশ লাইটের নিচে বসে শুনতে হয়েছে কানফাটানো রক গান। এয়ারকন্ডিশনিং ব্যবস্থা চালু করে বন্দির ঘর প্রচন্ড ঠান্ডা করা হয়৷ সেই তীব্র ঠান্ডার মধ্যে তাদের থাকতে বাধ্য করা হতো।
পত্রিকাটি জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের সময় মোহাম্মদ আল-কাহতানি নামের এক বন্দির দেহে সাড়ে তিন ব্যাগ তরল পদার্থ প্রবেশ করানো হয় এবং তাকে টয়লেটে যেতে বাধা দেওয়া হয়। তাকে জামার মধ্যেই মল-মূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ওই অবস্থাতেই তাকে দীর্ঘ সময় ফেলে রাখা হয় এবং পরে তার গায়ে পানি ঢেলে দেওয়া হয়। নির্যাতনের বিভিন্ন সময় তাকে কুকুরে মতো ডাকতে বাধ্য করা হতো, তার চুল-দাড়ি সব চেছে ফেলা হয়। তাকে নারী সেনা সদস্যদের মাধ্যমে অপদস্থ করা হতো, নারীদের অন্তর্বাস পরতে, নগ্ন হয়ে নাচতে বাধ্য করা হতো এবং তার দেহে ঋতুকালীন রক্ত ছুড়ে মারা হতো (এগুলো ভুয়া রক্ত ছিল, কিন্তু বন্দিদের বিশ্বাস করানো হতো এগুলো সত্যিকারের, যাতে তারা নিজেদের অপবিত্র মনে করে)।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নির্যাতন ও বিনাবিচারে আটকের প্রতিবাদে পাকিস্তানের নাগরিক মজিদ খান অনশন করেছিলেন। এর জন্য শাস্তি হিসেবে তার পায়ুপথ দিয়ে খাবার প্রবেশ করানো হতো। নির্যাতনের সময় যৌনাঙ্গে বরফ শীতল পানি ঢালা হতো, নগ্ন করে রাখা হতো, গোপনাঙ্গ স্পর্শ করা হতো।
মজিদ তার আইনজীবীকে জানিয়েছিলেন, মাতাল ইন্টারোগেটরা হাতুড়ি দিয়ে, বেজবল ব্যাট দিয়ে এবং লাঠি ও চামড়ার বেল্ট দিয়ে তাকে পেটাতো। তাকে নগ্ন করে কাঠের আঁড়ার সঙ্গে তিন দিন ঝুলিয়ে রাখা হতো, দেহের নিচের অংশ বরফ পানির মধ্যে চুবিয়ে রাখা হতো, নাকে মুখে পানি ও বরফ ঢেলে দেওয়া হতো। জিজ্ঞাসাবাদের সময় শরীরে বরফ ঢেলে দিয়ে ফ্যান ছেড়ে দেওয়া হতো। নির্যাতনের এক পর্যায়ে চিকিৎসক শারীরিক অবস্থা দেখতে আসলে তার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন মজিদ। কিন্তু সেই চিকিৎসক যাওয়ার সময় গার্ডদের ফের মজিদকে ঝুলানোর নির্দেশনা দিয়ে যেত।
গুয়ান্তানামোতে আটক অধিকাংশ বন্দিই যে নির্দোষ তা স্বীকার করেছিলেন খোদ বুশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সাবেক চিফ অব স্টাফ লরেন্স বি উইকারসন তার ব্লগে লিখেছেন, গুয়ান্তানামোতে আটক অনেক বন্দি নির্দোষ। কে দোষী আর কে নির্দোষ সেই ব্যাপারে কোনো পার্থক্যই করতো না মার্কিন বাহিনী।
তিনি বলেন, ‘কোনো বন্দি নির্দোষ কিনা সেটা ব্যাপার না। সে আফগানিস্তানে বাস করেছে এবং যুদ্ধক্ষেত্র কিংবা এর কাছাকাছি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেটাই ব্যাপার...।’
২০০২ সাল থেকে গুয়ান্তানামোতে অন্তত ৭৮০ জন বন্দিকে রাখা হয়েছিল। এদের মধ্যে মাত্র ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। বছরের পর বছর বিনাবিচারে আটক থাকার পর অধিকাংশকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে কিংবা মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং ৯ জন কারাগারের ভেতরেই মারা গেছেন।