২০০৯ সালের মার্চ বিশ্ব ক্রিকেটে এক কলঙ্কিত অধ্যায়, যার প্রভাব এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে পাকিস্তান। সেদিন ১২ জন বন্দুকধারী লাহোরে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দলকে বহনকারী বাসের ওপর হামলা চালায়, সফরকারী ক্রিকেটাররা প্রাণে বেঁচে গেলেও হতাহত হন অনেকে। সঙ্গে সঙ্গে নির্বাসিত হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও। ২০১১ সালের পরবর্তী ওয়ানডে বিশ্বকাপের সহআয়োজক হওয়ার মর্যাদাও হারায় তারা। তাতে আর্থিক লোকসানও গুনতে হয়েছিল সেবার। কিন্তু তারা মাঠে মোক্ষম জবাব দিয়েছিল ওই বছর মানে ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে!
এক যুগ আগের পুরোনো গল্প এখন কেন? এই প্রশ্ন মনে আসা অস্বাভাবিক নয়। এতদিন পর তা বলার কারণ আরেকটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে নিরাপত্তা হুমকিতে পাকিস্তানের ‘সম্মানহানির’ ঘটনা। তিনটি ওয়ানডে ও পাঁচটি টি-টোয়েন্টি খেলতে গত ১১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান গিয়েছিল নিউ জিল্যান্ড। ১৮ বছর পর দেশটিতে প্রথমবার পা রেখেছিল তারা। মূল দল নয়, কেন উইলিয়ামসন-ট্রেন্ট বোল্টদের ছাড়া দ্বিতীয় সারির দল। টম ল্যাথামের নেতৃত্বে কিউইদের পা পড়েছিল। কয়েকদিন অনুশীলনও করল তারা। দেড় যুগ পর তাদের বিপক্ষে দেশের মাটিতে সিরিজ আয়োজনের রোমাঞ্চ চারিদিক, দর্শকরাও তার স্বাক্ষী হতে অপেক্ষায়। কিন্তু আচমকা এলো খবর, ‘সুনির্দিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য হুমকি’ পাওয়ায় তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশ ছাড়ছে নিউ জিল্যান্ড। নিরুপায় হয়ে প্রথম ওয়ানডে শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে সফর বাতিল করল নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট।
তাদের এমন সিদ্ধান্তে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চক্ষু চড়কগাছ। সদ্য চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া রমিজ রাজা সফলভাবে এই সিরিজ সম্পন্নের যে স্বপ্ন দেখছিলেন, তাতে আচমকা ইতি টানতে দেখে রেগে আগুন। নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটকে আইসিসিতে একহাত দেখে নেওয়ার হুমকি। অলরাউন্ডার মোহাম্মদ হাফিজও সুযোগ ছাড়লেন না। ক্রিকেটার ও সফরকারী বোর্ডকে একহাত নিলেন।
স্বাগতিক দেশের সংশয় দূর করতে গিয়ে নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট জানাল, তাদের পাঁচ জাতির গোয়েন্দা জোটের পাওয়া তথ্যে নিরুপায় হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তাদের কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিল না। নিরাপত্তা হুমকির তথ্য ছিল বিশ্বাসযোগ্য। বড় ধরনের কিছু হয়েও যেতে পারত। দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ড ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে টেলিফোনে কয়েকবার আলাপের পর সিরিজ বাতিলের অযাচিত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে হয় তাদের। তাহলে এখন?
ধরে নেওয়া যেতে পারে, আপাতত নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক লড়াই চালিয়ে যাবে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড। কিন্তু এত সময় কি আছে ক্রিকেটারদের হাতে! টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের সিরিজ খেলে যে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ, সেটা পেলেন না বাবর আজমরা। কিন্তু মাঠে তো জবাব দেওয়া যেতেই পারে, যেমনটা দিয়েছিল ২০০৯ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে।
ওইবার জুনে বিশ্বমঞ্চে লড়াইয়ের মাস তিনেক আগে এপ্রিলে পাকিস্তান বোর্ড জানতে পারে, ২০১১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজনের মর্যাদা হারাচ্ছে তারা। অনেক চেষ্টা তদবির করেও আইসিসির এই সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারেনি। তবে জানিয়েছিল, ওই ‘অপমানের’ জবাব তারা দিবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। ১২ বছর আগের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব, সুপার এইট কোনোরকমে পার করে সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শেষ ওভারে রোমাঞ্চকর জয়ের পর ফাইনালে ইউনুস খানরা শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে হয় চ্যাম্পিয়ন।
এবার দলে নেই ওই বিশ্বকাপ অভিযাত্রায় থাকা কেউই। বাবর নেতৃত্ব দিবেন একঝাঁক তরুণদের নিয়ে গড়া দলকে। তারপরও ফেভারিট হিসেবেই মাঠে নামবে পাকিস্তান। কারণ কন্ডিশন তাদের চিরচেনা সংযুক্ত আরব আমিরাত, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নির্বাসিত হওয়ার পর যেখানে তারা খেলেছিল ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে। ছয়-সাত বছরের অভিজ্ঞতা আর স্টেডিয়ামে দর্শকদের উৎসাহ উদ্দীপনা কাজে লাগিয়ে যে কোনো কিছু ঘটাতে পারে ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ পাকিস্তান। তাদের ম্যাচই শুরু যে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে দিয়ে। বিশ্বকাপের মঞ্চে যাদের কখনো হারাতে পারেনি পাকিস্তান। কিন্তু তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ফাইনালে ভারতকে হারানোর স্মৃতি। আরেকটি কথা, এই নিউ জিল্যান্ডকেই সুপার টুয়েলভে গ্রুপ সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে পাকিস্তান। যদিও সবশেষ সফরে যাওয়া ক্রিকেটারদের কেউই নেই বিশ্বকাপে। কিন্তু নাম তো নিউ জিল্যান্ড।
এক যুগ আগের বন্দুক হামলায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নির্বাসনের সঙ্গে নিউ জিল্যান্ডের সফর বাতিলের ঘটনা তুলনামূলকভাবে ছোট্ট। কিন্তু এটি আবারও যে ঘরের মাঠে ক্রিকেট ধরে রাখার প্রচেষ্টায় ধাক্কা দিবে না তা তো নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাই পাকিস্তান তাদের মনোবল না ভাঙার প্রমাণ দিতে চাইবে। সব মিলিয়ে প্রথম দুটি ম্যাচের আগে টগবগ করে ফুটছে তারা, যার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে মোক্ষম জবাবে!