মতামত

মানুষের কৃতকর্মের দায় কাশফুল নেবে না 

আমাদের দেশে ছয়টি ঋতু রয়েছে। প্রত্যেক ঋতুর রয়েছে আলাদা সৌন্দর্য, যা একটু খেয়াল করলেই লক্ষ্য করা যায়। ছয় ঋতুর মধ্যে শরৎকাল স্বতন্ত্র ও ভিন্নমাত্রিক; এই ঋতুর স্পর্শে রয়েছে শুভ্রতার নির্মল নির্জন শিহরিত পুলক! মন অন্য রকম হয়ে যায়; হৃদয় স্পন্দিত হতে থাকে- কোথায় পাবো তারে! সেই মনের মানুষের অদৃশ্য এক বন্ধনে কল্পনা ছুটে চলে সাদা মেঘের ভেলায়। অপার বিস্ময়ে হৃদয় পূর্ণ হয়ে ওঠে। আবেগ তৈরি হয় দেহমনে। আমরা দেখতে পাই, এই ঋতুকে কেন্দ্র করে বাংলাসাহিত্যে যে সব কবিতা বা পদ রচিত হয়েছে, তা হৃদয় স্পর্শ করে।

যেমন ধরুন, ঘাসের উপর শিশিরের কোমল ছোঁয়া, তার উপর দিনের প্রথম সূর্যের আভা, শিউলি তলায় ঝড়া ফুল, ভোরের রাতে শীতের আমেজ, আকাশে সাদা মেঘের ভেলা পেঁজা তুলোর মতো, নদীর ধারে কাঁশ ফুলের বন, সেখানে দামাল বাতাস বইছে, বাউলের দোতারায় বেজে ওঠে টান- সে এক অপার বিস্ময়ে নাগরিক হৃদয়ে ছেলেবেলা যেন টেনেহিচঁড়ে নিয়ে আসে। মনের ভেতরে যে অন্য একটা মন লুকিয়ে থাকে, তার সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় এই ঋতুতে।

এই শরৎ কালেই সনাতন বাঙালি উদযাপন করে শারদীয় দুর্গোৎসব। উপমহাদেশের এই অঞ্চলে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন, তা এই শারদীয় উৎসবে, এই ঋতুতেই লক্ষ্য করা যায়। উৎসব মানেই আনন্দ, উৎসব মানেই মেলবন্ধন। শরৎকাল নিয়ে কথা বলতে গেলেই মনের অজান্তেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা চলে আসে:  ‘আজিকে তোমার মধুর মুরতী হেরিণু শরৎ প্রভাতে হে মাত বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ ঝরিছে অনল শোভাতে।”  এই কারণেই চর্যাপদের কবি থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক তরুণ কবিরাও শরতের নান্দনিকতায় সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যের অমিয় সুধা।

শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক! গাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জোছনা, আলোছায়ার খেলা অহর্নিশ- এই সব মিলেই তো শরৎকাল। শরতে আকাশে অন্তহীন সাদা মেঘের এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো, যেন মায়ের অবাধ্য ছেলে অন্তহীন পথে ধেইধেই করছে; সাদার উপর মহাজাগতিক নীলের হাতছানি। আবারও সেই  কবিগুরুকেই স্মরণ করিয়ে দেয়:  ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।’ ভিন্নমাত্রার কবি জীবনানন্দ দাশ, যিনি বাঙালিকে বেদনা কিংবা দুঃখের রঙ চেনাতে শিখিয়েছেন তার কবিতার মধ্য দিয়ে। তিনি শরৎ নিয়ে কবিতায় একাকীত্বের দুঃসহ বেদনার রঙ এঁকে দিচ্ছেন: ‘এখানে আকাশ নীল নীলাভ আকাশজুড়ে সজিনার ফুল ফুটে থাকে হিম সাদা রঙ আশ্বিনের আলোর মতোন; আকন্দ ফুলের কালো ভীমরুল এখানে করে গুঞ্জরণ।’ 

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম

এই উচ্চারণের পর মুখে আর ভাষা থাকে না। নীরবে নিজেকে মিলিয়ে নিতে হয় নিজের সাথে, সত্যি এখানে আকাশ নীল..। শরতের যে নান্দনিক রূপ ও মাধুর্য আছে, সে উপলব্ধি আমরা দেখতে পাচ্ছি বৈঞ্চব পদাবলীর মধ্যে কবি বিদ্যাপতির কণ্ঠে। তিনি রাধা বিরহের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তা শুনে প্রতিটি বিরহ কাতর হৃদয় হাহাকার করে ওঠে: ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর।’  

মূলত এখানে বিদ্যাপতি ভাদ্র মাস কে নিয়ে পদ রচনা করেছেন। অপরদিকে সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি কলিদাস তাঁর ‘ঋতুসংহার’ কাব্যে শরতকে নারী দেহের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন:  ‘কাশফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মুক্ত হাসের ডাকের মতো রমণীয় যার নুপূরের শব্দ, পাকা শালি ধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা, অপরূপ যার আকৃতি সেই নববধূর মতো শরৎকাল আসে।’

কবি কালিদাস মেঘদূত কাব্যগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, পৌরাণিক এক গল্পগাথা, সেখানে মেঘকে তিনি দূত হিসেবে আখ্যা দেন। স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে পতিত প্রেমিক যক্ষ প্রিয়ার বিরহে কাতর। তাই তিনি বর্ষার মেঘকে বার্তা বাহক হিসেবে প্রেমিকার কাছে পাঠান, বিরহী বর্ষা শেষে শরতের আগমনে তার মনের আকাশও প্রিয়া মিলনের আশায় চঞ্চল হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ , নববধূর ন্যায়  সুসজ্জিত শরতকাল সমাগত।’

শরৎ নিয়ে প্রেমিক কবিদের হৃদয়ে উপমার শেষ নেই। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গহীন হৃদয়ে ঝরনার মতো জমানো প্রেম, সত্যি বিস্মিত করে। কবি ‘রাখিবন্ধন’ কবিতায় শরতের যে রূপ তুলে ধরেছেন তা বিস্ময় জাগানীয়া: ‘সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণী? নীলিমা বাহিয়া ওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণী! অলাকার পানে বলাকা ছুটেছে মেঘদূত মন মোহিয়া চঞ্চু রাঙা কলমীর কুড়ি মরতের ভেট বহিয়া। সখি গাঁয়ের সেঁউতি বোটার ফিরোজায় ঢঙ পেশোয়াজ আসমানী আর মৃন্ময়ী সখি মিশিয়াছে , মেঠোপথ মাঝ।’

এই নাগরিক বন্দী জীবনে শরৎ কাল আসে আবার চলে যায়। মেঘমালা যেন দূত হয়ে আমাদের কানে কানে শোনায় জীবনের মর্মবাণী। শুভ্র মেঘের মতো ভেসে চলো জীবনের পথে, কখন মেঘ, কখন বৃষ্টি তবুও উপরে থাকে সীমাহীন লক্ষ্যে ওঠার নীলাকাশ, যেখানে অনন্ত নক্ষত্ররাজি বিচরণ করে। আমরা মেঘ হয়ে ভাসতে থাকি, স্বপ্নের অদৃশ্য ডানায় ভর করে। মানব জীবনের মূল্যবোধের যে অপার সৌন্দর্য শরতের কাশফুলের ছোঁয়ায় শিহরিত হয়ে ওঠে, তা মহাবিশ্বের আর কোথাও মিলবে না। তাই প্রকৃতি প্রতিনিয়ত তার বিভিন্ন ঋতুর বহুমাত্রিক রূপ ও মাধুর্যের মধ্য দিয়ে যে আবহ তৈরি করে, সেই পাঠ মানবের গ্রহণ করা উচিত। কেননা, প্রকৃতি আমাদের কখনও ভুল শেখায় না। যেহেতু প্রকৃতির মাঝে লুকিয়ে থাকে মহাবিশ্বের অনন্ত নক্ষত্ররাজির বার্তাসমূহ। সেই অভিন্ন বার্তা এক নক্ষত্র থেকে অনন্ত নক্ষত্র হৃদয়ে ছড়িয়ে পরে সত্য-সুন্দরের জ্যোতির্ময়তায়; এ এক অপার্থিব সুখ যা প্রকৃতির কাছে চাওয়া মাত্র উপলব্ধি করা যায়।

কিন্তু সিলেটের গোলাপগঞ্জে চৌঘরী এলাকায় যে ঘটনাটি সম্প্রতি ঘটে গেলো এ জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সেখানে একটি কাশবনে আগুন দিয়েছেন স্থানীয়রা। অভিযোগ কাশবনে অশ্লীল কর্মকাণ্ড হয়। কিন্তু দর্শনার্থীরা বলছেন ভিন্ন কথা। মানুষের বেড়ানোর জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এই শরৎ কালে তারা যদি কাশফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চায় সেখানে বাধা দেয়ার কিছু নেই। অশ্লীল কর্মকাণ্ডের অভিযোগ থাকলে প্রশাসনের সহায়তা নেওয়া যেত। যারা কাজটি করেছেন তারা নিঃসন্দেহে প্রকৃতি ধ্বংস করেছেন, বন পুড়িয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। মানুষের কৃতকর্মে কাশবনের অপরাধ কোথায় যে কারণে তাকে পুড়তে হবে? এই প্রশ্নটি স্থানীয় কারো মাথায় আসেনি। আসা উচিত ছিল।  

লেখক: বিজ্ঞান গবেষক ও গল্পকার