সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য যুগে যুগে নারীরা ব্যবহার করে আসছেন নানা রকম গয়না। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে গয়নার উপকরণে এসেছে পরিবর্তন। সেইসঙ্গে নকশা ও আকারেও আমূল পরিবর্তন লক্ষণীয়। বর্তমানে অ্যান্টিক বা সিলভার গয়না অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নান্দনিক নকশা এবং রঙ দিয়ে এসব গয়নাকে ফ্যাশন সচেতন তরুণীদের নিকটও জনপ্রিয় করে তুলেছেন শিল্পীরা। তারা গলার হার, হাতের চুড়ি, কানের দুল, ঝুমকা, চেন, পায়েল ও নূপুর তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছেন। এই গয়না তৈরি করে যেমন অন্যকে সাজতে সহায়তা করছেন, তেমনি একে অবলম্বন করে জীবিকাও নির্বাহ করছেন।
আশির দশকে বাংলাদেশে প্রচুর স্বর্ণ ও রূপার গয়না তৈরি হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে দাম বাড়তে থাকায় কারিগররা তামা ও পিতলের গহনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। ৯০ এর দশকে এসে এখানে ইমিটেশন গয়নাই মূলত তৈরি হতে থাকে। বাজারেও তামা ও পিতলের গয়নার চাহিদাও বেড়ে যায় ক্রমান্বয়ে। আর এতে বগুড়া ঝিনাইদহ ও ঢাকার কিছু গ্রামে বাড়তে থাকে গয়না তৈরির তোড়জোড়।
ইমিটেশন গয়না শিল্পে বাংলাদেশের অনেক পরিবার নতুন করে বাঁচার প্রেরণা খুঁজছে। বগুড়ার অ্যানটিক পল্লী গড়ে ওঠে প্রায় ৫০ বছর আগে জেলা শহরের উপকন্ঠ ধরমপুর ও বারপুরে। ২০ হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষ নিখুঁতভাবে তৈরি করেন গয়না। এই পল্লী করোনার শুরুতে মুখ থুবড়ে পড়লেও আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অ্যানটিকে কাজ করে তাদের জীবনমান পাল্টে গেছে।
সকালের নাস্তা করে নারী-পুরুষ লেগে যান অ্যান্টেকের গয়না তৈরির কাজে। সকালে গয়না বানানোর ছোট ছোট হাতুড়ির খুটখাট শব্দে গ্রামর মানুষের ঘুম ভেঙে যায়। আগে কয়লার আগুনে পিতলের নল দিয়ে গয়নার জোড়া লাগানো হতো। এখন প্রযুক্তি পাল্টে গেছে, তারা গ্যাসের পটে চাপ দিয়ে অ্যানটিকের গয়নাকে জোড়া লাগায়। তারা একটি মোমের ছাঁচে অ্যানটিকের গহনা জোড়া দিয়ে তৈরি করেন নানা ডিজাইনের প্রসাধনী। এসব অ্যানটিক তৈরি হয় তামা, পিতল ও দস্তার সংমিশ্রনে। এগুলো প্রায়ই আমদানি হয়ে থাকে ভারত থেকে।
ইমিটেশন গয়না শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত কিউবিক জারকনিয়া বা নকল হীরার মূল জোগানদার ছিল চীন। অপূর্ব কারুকাজে তৈরি হচ্ছে চোখ ধাঁধানো গয়না। এগুলো সোনা নাকি অন্য কোনো মূল্যবান পদার্থের, তা ধরার কোনো উপায় নেই। অনেকে যারা রিকশা চালাতেন, দিন মজুর ছিলেন বা অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের অধিকাংশই প্রথমে অ্যানটিক কারখানার শ্রমিক ছিলেন। এরপর তারা নিজেরাই এখন অ্যানটিক শিল্পের মালিক। এর কাঁচামাল আসে ভারত থেকে। কারণ, সেখানে তামা, ব্রোঞ্জ, দস্তা পিতলের খনি আছে।
করোনার প্রথম দিকে লকডাউন দেওয়ায় তাদের লোকসান গুনতে হয়েছে। মহামারির মধ্যে কাঁচামালের ব্যয় বাড়ার কারণে মুনাফা কম ছিল। তবে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে মহামারি শুরুর আগ পর্যন্ত এটি অত্যন্ত লাভজনক একটি ব্যবসা ছিল। কিন্তু পরে ভারত ও চীন থেকে আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে কাঁচামালের দাম বেড়ে যায়। ফলে মহামারি পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় ব্যবসা প্রায় ৭০ শতাংশ কমে যায়। কোনো সরকারি প্রণোদনা ছাড়াই একটি সম্ভাবনাময় শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে নিজস্ব অর্থায়নে।
ঢাকার নিকটবর্তী বুড়িগঙ্গা তীরের গ্রামীণ এবং শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা এক জনপদ ভাকুর্তা। সাভার উপজেলার ইউনিয়ন এটি। গয়না তৈরিই যাদের প্রধান পেশা। এই শিল্প এসে একদম আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে এই জনপদের। ভাকুর্তায় তৈরি গয়নার কাঁচামাল আনা হয় পুরাণ ঢাকার তাঁতিবাজার এবং বগুড়া থেকে। তাঁতিবাজারের ব্যবসায়ীরা এসব কাঁচামাল আবার আমদানি করেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। প্রাথমিকভাবে তৈরি গয়নাগুলো অপরিশোধিত অবস্থায় থাকে। এখান থেকে পাইকাররা কিনে নিয়ে পরিশোধন ও রঙ করে বাজারে বিক্রি করে থাকেন। ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার প্রায় ১০ হাজার পরিবার সুদিনের দেখা পাচ্ছে এই শিল্পের কারণে।
এসব এলাকায় নারী-পুরুষ কারিগরদের কর্মসংস্থানের উৎস তৈরি হয়েছে। অ্যান্টিকের গয়না তৈরির আয় থেকে এ এলাকার নারীরা নিজেদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করেছেন। প্রায় ১৫০ বছর আগে থেকে এখানে গয়নার কাজ শুরু হয়। সে সময় পিতলের গয়না তৈরি হতো। পরে একপর্যায়ে সোনার গহনার চাহিদা বাড়তে থাকে। কিন্তু ৮০ দশকের শেষে আবার সোনার গয়নার চাহিদা বাড়তে থাকে। তখন থেকে একটু একটু করে অ্যান্টিক শিল্পের দিকে ঝুঁকতে থাকে কারিগররা। এরপর ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালের দিকে পুরোদমে শুরু হয় অ্যান্টিকের গহনা তৈরি। বাজারে প্রতিদিন অন্তত ৫০ লাখ টাকার গয়না পাইকারি বিক্রি হয়। সে হিসেবে মাসে সাড়ে ১৫ কোটি টাকার লেনদেন হয় গয়নাকে কেন্দ্র করে; বছর শেষে যার পরিমাণ হয় প্রায় ১৮০ কোটি টাকা।
এ কাজে এত মানুষ যুক্ত হওয়ার কারণ রোদ-বৃষ্টির মধ্যেও কাজ চলে সমানতালে। বাড়ির বউ-ঝিয়েরাও গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে করতে পারেন এ কাজ। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে যুক্ত হন শিক্ষার্থীরা। গয়না শিল্পের কারণে এ এলাকার কেউ আর বেকার বসে নেই। প্রায় প্রতি ঘরেই আছে তৈরির সরঞ্জাম। রাস্তার পাশে, বাজারে বাজারে গড়ে উঠেছে কারখানা, দোকান। গয়নার ধরনে এটি কুটিরশিল্প হিসেবে বিবেচিত।
উদ্যোক্তারা চাইলে বিসিক শিল্পনগরীতে কারখানা তৈরির জায়গা এবং সরকারিভাবে ব্যাংকঋণের সহায়তা পেতে পারেন। কিন্তু সরকার বা শিল্পনগরী সংশ্লিষ্ট কেউ এই কাজে তেমন দৃষ্টিপাত করেন না। ফলে নিজেদের অর্থায়নেই পৈত্রিক ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখেছেন কারখানা মালিকেরা। গয়না গ্রামের শ্রমিকদের উৎসাহিত করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান বাড়াতে সরকারিভাবে ঋণের ব্যবস্থা করার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিৎ।
দেশের এমন ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সাধারণ ক্রেতার পাশাপাশি সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে তাদের পুঁজি বৃদ্ধি ও ব্যবসায় প্রসারে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা করতে হবে। এছাড়াও এ শিল্প জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাজারজাতকরণে সঠিক প্রচারণায় সরকারি সহযোগিতার বিকল্প নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।