কষ্টের শুরু তো সেখানে, যেখানে বাংলাদেশকে চলমান টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে অংশ নিতে বাছাইপর্ব খেলতে হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের চেয়ে পরে আবির্ভূত আফগানিস্তান মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছে। র্যাংকিংয়ে আমাদের চেয়ে দুই ধাপ এগিয়ে অষ্টম অবস্থানে থাকায় তারা এ সুবিধা পেয়েছে। ধরে নিলাম এটি আমাদের কয়েকটি প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দিয়েছিল, কিন্তু কষ্টের নতুন মাত্রা যোগ হয় যখন স্কটল্যান্ডের কাছে দ্বিতীয়বারের মতো হারতে হয়। বাংলাদেশ দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বিচার করলে বেশ কিছু কষ্ট আর হতাশার চিত্র ফুটে ওঠে। বলতে দ্বিধা নেই যে, প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল। দেশের মাটিতে খর্ব শক্তির অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড-এর বিপক্ষে সিরিজ জিতলে চূড়ান্ত প্রস্তুতি হয়ে যায় না। মাথায় রাখা উচিত ছিল- আমাদের স্পিনিং পিচের অনুশীলন সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্পোর্টিং উইকেটের সঙ্গে মিলবে না।
এবারের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ প্রথমবারের মতো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বাইরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছে। দুবাই, শারজাহ ও আবুধাবীর উইকেট বরাবরের মতোই ব্যাটিং সহায়ক; যদিও খুব বড় রান এখনো কেউ করতে পারেনি।
বিজ্ঞাপনকেন্দ্রিক যে টুর্নামেন্ট তার উইকেট ব্যাটিং সহায়কই হয়। যদিও শেষের দিকে ব্যাট করা একটু কঠিন মনে হচ্ছে। এটুকু নিশ্চিত টুর্নামেন্টের উইকেট শুধু স্পিন সহায়ক নয়। তবে পরিসংখ্যানের দিক থেকে শারজার পিচে ফাস্ট বোলাররা বেশি সফলতা পাচ্ছেন। ঘরের মাঠে দুটি সিরিজ জয় যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল কার্যত তা কাজে আসেনি। বলা হয়েছিল আমাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে এবং সেই আত্মবিশ্বাসে ভর করে টুর্নামেন্টের মূল পর্বে ভালো করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ দলের শরীরের ভাষা ও আত্মবিশ্বাসের যে দুর্বল অবস্থা তা বুঝতে কারো বড় মাপের বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন পড়ে না।
দলের দ্বিতীয় সমস্যা হলো, আমরা এখনো আমাদের মূল একাদশ ঠিক করতে পারিনি। সবাই সব ম্যাচে ভালো খেলবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর পর সেরা একাদশ নির্বাচন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ একেবারেই নেই। সমস্যার শুরু ব্যাটিং থেকেই। অন্তত তিনটি সমস্যা প্রকট, এক. ব্যাটিং অর্ডার এখনো ঠিক করা যায়নি, দুই. ওপেনারদের কাছ থেকে বড় রান আসছে না, এবং তিন. পাওয়ার-প্লেতে প্রায় সবাই ব্যর্থ।
তামিম খেলতে না যাবার কারণ আমাদের অজানা, কিন্তু সে আমাদের সেরা ব্যাটার। তার জায়গায় আমাদের বিকল্প তৈরি হয়নি। লিটনের ব্যাটিং নিয়ে যত কথাই হোক আমাদের হাতে বিকল্প নেই। ব্যাটারদের পারফরম্যান্স দুটি বিষয়ে উপর নির্ভর করে, উইকেটের চারপাশে খেলার দক্ষতা এবং ফুটওয়ার্ক। যদি এ দুটির ঘাটতি থাকে তবে বলে লেন্থ বুঝে হার্ড হিটিং শিখে নিতে হয়। বর্তমান সময়ে এ রকম আনেক ব্যাটার রয়েছেন যারা শারীরিক শক্তি দিয়েই খেলছেন। আর টি-টুয়েন্টি হলে তো কথাই নেই, প্রতি বলে ছক্কা প্রয়োজন না-ও হতে পারে, তবে ছক্কা মারার মানসিকতা ও যোগ্যতা থাকতে হয়।
বোলিং বিভাগের পারফরম্যান্স গতানুগতিক। ব্যাটিং-এর মতো এখানেও বিকল্প নেই। মুস্তাফিজের সঙ্গে আর কোন পেসার খেলবে ঠিক করা যায়নি এখনও। অথচ আমরা টুর্নামেন্টের মাঝপথে আছি। আসলে দীর্ঘ সময় ধরে আমরা পেসার তৈরি করতে পারিনি। এমনকি আফগানিস্তানের মুজিব কিংবা নামিবিয়ার রুবেন ট্রাম্পেল্ম্যানের মতোও কেউ নেই। নাসুম ঘরের মাঠে সিরিজে ভালো করলেও তাকে মূল একাদশের বাইরে থাকতে হয়েছে। এমনকি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাকে বসিয়ে রেখে দলনায়ক মাহমুদউল্লাহ নিজে বল হাতে তুলে নিয়েছেন। দেশের নাগরিক ও দর্শক হিসেবে সবাই নিজ দলের খেলার একটা সম্ভাব্য হিসাব করে নেয়। একজন ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে আমি ধারণা করেছিলাম- বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে জিতবে।
হাল আমলে লঙ্কান ক্রিকেটের অবস্থা খারাপ। যে কারণে তাদেরকেও আমাদের মতো বাছাইপর্ব খেলতে হয়েছে। আর বুড়োদের উপর সওয়ার হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের উপর ভরসা কম ছিল। প্রথম দুটি ম্যাচ জেতার যে আপাত সম্ভাবনা ছিল সেটি করতে পারলে পরে কোনো একটি দলের বিপক্ষে জয়ী হলে কিংবা নেট রানরেটে সেমিফাইনালে যাওয়ার একটি ক্ষেত্র তৈরি হতো। প্রত্যাশা অনুযায়ী ইংল্যান্ড-এর সঙ্গে হেরেছি আর অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গেও হারার সম্ভাবনা বেশি। অস্ট্রেলিয়া দলের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে তারা টি-টুয়েন্টি পারফর্মার দিয়েই দল সাজিয়েছে।
ফিল্ডিং-এর কথা বিবেচনা করলে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে খারাপ দল আমাদের। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে লিটনের সহজ (এসব বড় টুর্নামেন্টের জন্য) দুটি ক্যাচ আমাদের জয় বঞ্চিত করেছে। মানসিক চাপ থেকে যদি হয়ে থাকে তবে সেটি কেন অর্জন করা যায়নি? মানসিক চাপ তো এসব টুর্নামেন্টের সৌন্দর্য। যদিও সেদিন ম্যাচ হারার পেছনে অধিনায়কের ব্যর্থতাও রয়েছে। একজন ব্যাটার হিসেবে মাহমুদউল্লাহ দলের সবচেয়ে কম্প্যাক্ট হলেও অধিনায়ক হিসেবে অনেক কিছু শেখার বাকি রয়েছে তার। টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে ফিল্ডিংয়ের বিশাল ভূমিকা থাকে। একটি ভালো ক্যাচ বা রান আউট ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে যা এখনো আমাদের করে দেখানো সম্ভব হয়নি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে গত ম্যাচে আফিফ মাত্র এক রানে ব্যাট করা জেসন হোল্ডারের লোপ্পা ক্যাচ এক্সট্রা কভারে মিস করেছেন। হোল্ডার জীবন পেয়ে ৫ বলে ১৫ রানের এক দারুণ ক্যামিও খেলে লো-স্কোরিং ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দেন। আবার তিনিই বাংলাদেশ ইনিংসের ১৯ নম্বর ওভারে বাউন্ডারিতে মন্থর গতিতে ব্যাট করা লিটনকে এক অসাধারণ ক্যাচ ধরে তাকে সাজঘরে পাঠান।
আমাদের ক্রিকেট কতটুকু এগিয়েছে সেটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে। খেলার পাশাপাশি আরও অনেক কিছু বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। যেমন এ টুর্নামেন্টে ম্যাচ রেফারি কিংবা আম্পায়ার হিসেবে আমাদের কেউ নেই। এটি সত্য বাংলাদেশ সবচেয়ে কঠিন গ্রুপে পড়েছে। দুপুরে খেলা হয়েও কোনো সুবিধা হয়নি যদিও এ নিয়ে আত্মতৃপ্তি ছিল। এ ছাড়া মাঠের বাইরের আলাপচারিতা ড্রেসিং রুমে প্রভাব বিস্তার করছে বলেও প্রতীয়মান হচ্ছে। নিজ দলের দর্শক হিসেবে আমরা সবাই চাই আমার দল সব খেলায় জয়লাভ করুক। দর্শক হিসেবে এটি আমাদের সীমাবদ্ধতা। মাহমুদউল্লাহর মতো আমরা সবাই জানি- মানুষ মাত্রই ভুল করে। কিন্তু এক জীবনে কতগুলো ভুল করা যাবে তার একটি সন্তোষজনক সংখ্যা নির্ধারণ করা জরুরি। ‘নতুন করে শিখছি’, ‘ভুল থেকে শিখছি’, ‘আগামী ম্যাচে নুতন বাংলাদেশ দেখা যাবে’- টাইপের কথাগুলো বড় বেশি কষ্ট দিচ্ছে। আয়নায় যতবার নিজের চেহারা দেখছি তত বারই কষ্টে নীল হওয়া এক মুখ ভেসে উঠছে। তবুও দেশের পক্ষেই আমাদের বাজি। হারজিৎ ছাপিয়ে দেশের সমর্থনেই আমাদের সকল অনুভূতি।
লেখক: একজন ক্রিকেটপ্রেমী