আবার ফিরে এলো বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। অহংকার আর গৌরবের মাস এটি। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আমরা পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা শোভিত স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিল তরুণ প্রজন্ম। এই বিজয়ের মাসে কী ভাবছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকজন তরুণের বিজয় ভাবনা তুলে ধরেছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আজহারুল হক মিজান।
আব্দুজ জাহের নিশাদ
বিজয় মানেই আনন্দ। আর তা যদি হয় ৫০ বছর পূর্তির তাহলে সে আনন্দের শেষ কোথায়! প্রতিটা বিজয়ের পেছনে রয়েছে শ্রম, ধৈর্য, বিসর্জন এবং হারানোর বেদনা। তেমনি আমাদের মহান বিজয়ের পেছনেও রয়েছে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, লাখো মা-বোনের সম্ভ্রম, বীর সৈনিকদের দুর্দম সাহসিকতা। ১৯৭১ সালে আমাদের পূর্বপুরুষরা যুদ্ধ করেছিল একটি বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, অন্যায়-অবিচার এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে।
আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা তরুণ প্রজন্ম একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের গণতান্ত্রিক এবং মত প্রকাশের অধিকার থাকবে, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশ এবং দেশের জনগণকে প্রাধান্য দেবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে একটি বৈষম্যহীন- অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বে, এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
হাসনাত নাঈম পিয়াস
তারুণ্যের উদ্দীপনায় বিজয় মানে উল্লাস, মুক্তিযুদ্ধের মুক্তির উল্লাস, ডিসেম্বরের বিজয় মাসে নতুন এক স্বাধীনতার উল্লাস। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে সেদিনের ঘরে ঘরে দুর্গ তুলার ইতিহাস, বাঙালি জাতির দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির অধ্যায় হিসাবে আমাদের মুক্তির দীর্ঘশ্বাস হলো এই বিজয়ের মাস।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমাদের এই বিজয় এবং ৭১’এর বিজয়ের চেতনা আজ খুব কম দেখা যায়। সেদিনের সেই বিজয় ছিল কালো অধ্যায়ের মুক্তির বিজয়, বাঙালি জাতি হিসাবে আমাদের স্বাধীন হবার বিজয়। জাতির স্বাধীনতা এখনো সম্পূর্ণরূপে দৃশ্যমান হয়নি, আমাদের লাল ফিতার দৌরাত্ম্য সেটির মধ্যে একটি, সরকারি অফিস, আদালত, হাসপাতাল ইত্যাদি সরকারি সেবা নামক জায়গা থেকে জনগণের সর্বোচ্চ সেবাপ্রাপ্তি পাওয়ার কথা থাকলেও সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ সেই সুবিধা এখনো পায়নি।
তারুণ্যে ভাবনা থেকে আমি মনে করি, মুজিবশতবর্ষে এসে আগামীর পরিকল্পনাগুলা বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে দেশের সর্বক্ষেত্রে সরকারি দপ্তর, অফিস সেবাকে সুশাসন ও জবাবদিহিতার আওতায় এনে আরও জনবান্ধব এবং স্বচ্ছ করা হোক। এতে যেমন জাতি হিসাবে উন্নত হবো, তেমনি স্বাধীনতার সর্বোচ্চ সুফল আমরা ভোগ করতে পারবো।
শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ফাহমিদা আক্তার
নিজের দেশে সুন্দর, বৈষম্যহীন, স্বাধীন জীবন ধারণ করার লক্ষ্যে অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা। বিজয়ের গৌরব বাঙালির আবেগের কেন্দ্রবিন্দু। স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে আমাদের অর্জন অনেক। কিন্তু স্বাধীন দেশে আমাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য আন্দোলন হওয়ার কথা ছিল না। ক্রমবর্ধমান জিডিপি নিয়েও লড়তে হচ্ছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সাথে। তরুণদের মধ্যে দেশাত্মবোধের চর্চা নতুন আশা জাগায়। বিজয় দিবসে প্রত্যাশা থাকুক একটি নিশ্চিত জীবনের, মুক্তবুদ্ধি চর্চার সুযোগ এবং একটি দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ইসরাত জাহান
বিজয় শুধু তিন অক্ষরের শব্দ না। এর ভেতর রয়েছে অনেক গভীর এক অর্থ। দীর্ঘ ২৩ বছরের রাত দিন জেগে করে যাওয়া সাধনা, জনগণের রক্তস্রোত, সন্তান হারা মায়ের অশ্রুধারা, ধর্ষিতা বোনের আর্তনাদ আর লা লাখ শরণার্থীর ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের এক স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে শুরু করেছিল এক নতুন অধ্যায়ে পদার্পণ, ঠিক সেই দিন থেকে শুরু হয়েছিল এই বাংলার জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন, স্বৈরাচারী পাকিস্তানি মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া, অশিক্ষা বেকারত্ব দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন এবং আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গঠনের প্রক্রিয়া আর আজ স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন লক্ষণীয়।
আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দারিদ্রতা দূরীকরণে অনেক দূর এগিয়ে, পদ্মা সেতুর মতো নিজস্ব অর্থায়নে করা প্রকল্প, তবে শিক্ষা খাতে আরও দূর এগিয়ে যেতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি প্রতিহত করে আরও সমৃদ্ধ হতে হবে, সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।
শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
তাওহীদ হাসান
ডিসেম্বর শব্দটা শুনলে হৃদয়ের গহীনে ত্যাগ, সফলতা ও বিজয়ের সংমিশ্রিত হিমশীতল হৃৎস্পন্দন অনুভূত হয়। যারা কখনো পরাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করেনি, তারা কখনো স্বাধীনতা কিংবা বিজয়কে অনুভব করতে পারবে না। স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মাহুতি দানকারী বীরদের প্রতি রইল বিনম্র, অফুরন্ত, সহস্র শ্রদ্ধা ও সালাম। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও আমাদের প্রাপ্তি থেকে অপ্রাপ্তি ও হতাশার পাল্লাটা বেশ ভারী। অর্ধশত বছরে এসেও জনগণের শতভাগ মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার নিশ্চিতকরণে ব্যর্থ।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, রাষ্ট্র আয়ত্তাধীন সেবাখাতগুলোর অবস্থা খুব নাজুক, যা আমাদের বিজয়ের আনন্দকে ভূলুণ্ঠিত করে। আমাদের সমসাময়িক স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। দুর্নীতিমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, মাদকমুক্ত, স্বনির্ভর, সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র না গঠন করতে পারলে আবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরাধীনতার অগ্নিকুণ্ডে পতিত হতে হবে। তাই বিজয়ের মাসে তরুণদের দৃঢ় সংকল্প হওয়া উচিত, রাষ্ট্র ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুন্দর, সমৃদ্ধশালী, স্বনির্ভর, দুর্নীতিমুক্ত, ভিনদেশি প্রভাব মুক্ত স্বদেশ গঠন করা।
শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
তানভীর আহম্মেদ
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। দিনটির কথা মনে করলেই বুক গর্বে ভরে ওঠে৷এই দিনটিতেই আমরা বিশ্বের বুকে নিজের নাম স্বতন্ত্রভাবে লিখতে সক্ষম হয়েছি৷বিজয়ের মধ্য দিয়ে পেয়েছি বাংলাদেশ নামটির স্বীকৃতি। এই বিজয়ের পেছনে লাখো মানুষের আত্মত্যাগ এবং লাখো স্বপ্ন। দীর্ঘ দিনের শোষণ নিপীড়নের সমাপ্তি হয়েছিল এই বিজয়ে।
বাঙালি জাতি স্বপ্ন দেখেছিল এক নিরাপদ দেশের, যে দেশে কেউ শোষিত হবে না, হবে না করো অধিকার হরণ, শিক্ষা-চিকিৎসা সর্বক্ষেত্রে থাকবে নিশ্চয়তা। বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পরে দেশের অবকাঠামোগত অনেক উন্নতি হলেও আমরা দেশের সর্বস্তরের জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ, সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। রয়েছে সুশিক্ষার অভাব, রয়েছে বেকারত্বের সমস্যা। আমাদের কাছে প্রকৃত বিজয় আসবে সেদিনই, যেদিন আমাদের সব স্তরের মানুষ সুশিক্ষিত, কর্মক্ষম হবে এবং তাদের আমরা মৌলিক চাহিদাগুলো পুরোপুরি নিশ্চিত করতে পারবো।
শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।