আজকের এই বুদ্ধিজীবী কবরস্থান সেদিন ছিল না, এখানে ছিল ফসলের ক্ষেত। শীত, গ্রীষ্ম মাথায় নিয়ে ফসল দোল খেত এ জমিনে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকবাহিনীর জাতি-নিধন প্রক্রিয়া পরাস্ত করে বাঙালি যখন বিজয়ের কাছাকাছি ঠিক সেই সময়ে মিরপুর গোলারটেকের এই জায়গা হয়ে উঠলো গণকবর। বিজয়ের জন্য অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলো হলো নারকীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার। এমনকি তাদের দেহ পরিণত হলো শিয়াল-কুকুরের খাবারে- এই হলো ইতিহাস।
মিরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা মো. দরবেশ আলী (৬০) জানালেন, ট্রাকে করে বাঙালিদের এই মিরপুরে ধরে নিয়ে আসে বিহারি, রাজাকার আর খানসেনারা। গর্ত আগেই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। দরবেশ আলীর ভাষায়, ‘আমার বাড়ি এহানেই আছিলো। একদিন আগে এইহানে গাড়া কইরা মারছে লোকেগো। মহিলাও আছিলো। এইহানে তাদের মাইরা কবর দিছে। এইখানে কোনো মানুষ ছিলো না ওই টাইমে। পরের দিন সকালবেলা এইহানে আইছি- দেহি কবর, মানুষের হাত বাইর হয়া আছে; শিয়ালে খাইতাছে।’
দরবেশ আলীকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমরা একমিনিট পর আবার কথা বলবো। পাশেই ছিলেন মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের গোরখোদক মিন্টু মিয়া, যিনি দরবেশ আলীর খোঁজ দিয়েছিলেন। তিনিই জানিয়েছিলেন এই দরবেশ আলী প্রতিদিন কবরস্থানে আসেন তাদের সঙ্গে সেই ভয়াবহ দৃশ্যের গল্প করেন- একই গল্প- প্রায় প্রতিদিন করেন। কিন্তু আমি এসে দরবেশ আলীকে এই কবরস্থানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
মিন্টু মিয়া জানালেন, তার বাড়ি দুইটা। কিন্তু কোন বাড়ি গেলে তাকে পাওয়া যাবে তিনি জানেন না। শেষে উপায় তিনিই ঠিক করলেন- চলেন একটাতে না পেলে আরেকটাতে পাবো। কবরস্থানের খোলা জায়গায় ভেড়া ঘাস খাচ্ছে, নারী-পুরুষ, শিশুরা মাঠে- কেউ গল্প করছে, কেউ খেলছে। কোনো কোনো কবরের পাশে মোনাজাতরত মানুষ। কেউবা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। দৃশ্য ভেঙে হেঁটে যাওয়া কিন্তু দরবেশ আলীকে তার দুই বাড়ির কোনোখানে পাওয়া গেল না।
বুঝলাম আবার আসতে হবে। মিন্টু মিয়ার কাছ থেকে বিদায় নেই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আপা কবরস্থানের একপাশে একটু সবজি বাগান করছি। বলেন কি! অবশ্যই আপনার বাগান দেখে যেতে চাই। বাগানে শিম, বেগুন আরও কত কি। কিন্তু আরো আশ্চর্যের তখনও বাকি ছিল। চমকে গেলাম দরবেশ আলীকে দেখে যিনি বাগানের পাশে একা একা পায়চারী করছিলেন। যাকে খুঁজছি তাকে পাওয়ার সুখবোধ হলো। মানুষ মুঠোফোন ব্যবহার করলে এমন দৃশ্য নিশ্চয়ই তৈরি হতো না।
আমরা এসে দাঁড়াই মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ২ নম্বর গেইটের সামনে। জনসাধারণকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। সামনেই বুদ্ধিজীবী দিবস। রাজনীতির উঁচুমহলে যারা থাকেন তারা আসবেন সেদিন। চলছে তার প্রস্তুতি। সবকিছু বুঝিয়ে বলার পর নিরাপত্তাকর্মীরা রাজি হলেন। তবে শর্ত হলো আমার যা কাজ ১০ মিনিটে সেরে ফেলতে হবে। শুধু শর্ত দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না তারা, আমার সঙ্গে সঙ্গে চললেন। কিন্তু বিধিবাম! কয়েক পা হাঁটতেই উপস্থিত বড় সাহেবেরা ‘না’ করে দিলেন। অর্থাৎ প্রবেশ নিষেধ। তারা যত্ন নিয়ে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের খুঁটিনাটি দেখছেন।
অগত্যা মধুসূদন। গণকবরের পাশের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালাম। এক কবর থেকে আরেক কবরের দূরত্বে যেটুকু পথ সেখানে দাঁড়িয়ে কথা হলো দরবেশ আলীর সঙ্গে। সূর্যের আলো নিভে যাবার পর যে নিস্তব্ধতাটুকু তৈরি হয়েছিল সেইসব দৃশ্য বর্ণনায় তা মিশে যেতে থাকল। দরবেশ আলী জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লাশগুলো পরে তোলা হয়েছিল। সে সময় উপস্থিত ছিল মিত্রবাহিনীর লোকজন। কিন্তু লাশগুলো পরে কোথায় নেওয়া হয়েছিল সে কথা জানেন না তিনি। তখন দরবেশ আলীর কিশোর বয়স। শুধু জানেন মানুষ আর মানুষে ভরে গিয়েছিল এ অঞ্চল। সে দৃশ্যের স্বাক্ষী হয়ে আছেন নিজে।
এই কবরস্থানের সঙ্গে দরবেশ আলীর আত্মার সম্পর্ক। এখানে তার পৈত্রিক জমি ছিল। এখানে সে গণকবর হতে দেখেছে। পরবর্তী বিবর্তনও তার চোখ এড়ায়নি। গণহত্যা করেই পাকবাহিনী আর তাদের দোসররা থেমে থাকেনি। বাঙালির ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়েছে। তাদের পৈশাচিক উল্লাস দরবেশ আলীও দেখেছে যেদিন তাদের ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হলো। এরপর তারা সপরিবারে চলে যান সাভারের বিরুলিয়া। ফিরে এসেছেন মিরপুর মুক্ত হওয়ার পর। কিন্তু সেই গল্প, সেই দৃশ্য ভোলেননি দরবেশ আলী। নতুন কাউকে পেলেই শুনিয়ে দেন সেদিনের কথা। এ তো গল্প নয়, সত্যগল্প। যেসব গল্পে ভর করে এসেছে বিজয়, যে গল্পের রং-রূপ মিশে আছে জাতীয় পতাকায়।