স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে প্রাপ্তির কথা বললে কয়েকটি বিষয় উঠে আসে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ইতিহাস। পৃথিবীর খুব কম জাতিসত্তারই এমন ইতিহাস থাকে, যেখানে সে তার নিজের ভাষা, সংস্কৃতি; শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্তের বিনিময়ে অর্জন করে। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর জিন্নাহ সাহেব রাষ্ট্র ভাষা উর্দুর কথা তোলেন। এ সময় ছাত্ররা প্রথম প্রতিবাদ করে। সেই সাতচল্লিশ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে ইতিহাস— এটাই হচ্ছে প্রাপ্তি। এই ইতিহাসের ভেতর থেকে আমরা যেটা অর্জন করেছি তা হলো, অসাধারণ কিছু ছাত্র আন্দোলন, সেসব ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের। শোষণ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কৃষক-শ্রমিক ও ছাত্র আন্দোলনের যে সূত্রপাত, সম্মিলিত যে প্রচেষ্টা এটা একটা বিশাল প্রাপ্তি। কৃষক-শ্রমিক এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছাত্র কোনো একটা শোষণের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। এটা করেছেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে অন্যান্য শ্রেণি যারা আছেন এরা নগরভিত্তিক। যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি আমলা প্রভৃতি। যে সব মধ্যবিত্ত শ্রেণি তখন এই আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি একাত্মতা প্রকাশ করে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাদের কেউ কেউ সম্মুখ সমরে গেছে। আমরা জানি, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে; এ সময় দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। ওই সময়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে এই আন্দোলনকে বিশেষভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছিল আওয়ামী লীগ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর বিশাল বিজয় হলো। আসলে আওয়ামী লীগ হলো মধ্যবিত্তের দল। এই শ্রেণিটাই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। তার মানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই ভূ-খণ্ডের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে যদি প্রাপ্তবয়স্ক লোক ধরি চার থেকে সাড়ে চার কোটি, এই লোকগুলোর প্রত্যেকটা শ্রেণি অর্থাৎ কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র, সরকারি আমলা, রাজনীতিবিদ এরা সবাই এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এর ফলাফল আমরা দেখতে পাই শিল্প-সাহিত্য বা একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে যে প্রকাশ ভঙ্গি আছে তার প্রতিটা ক্ষেত্রে। সেই সঙ্গে কিছু নাম পাই যেমন: মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, নিজাম উদ্দিন। সাংবাদিক থেকে নিয়ে সরকারি আমলা পর্যন্ত এমন সব মানুষ পাই যারা শুধু রাজনীতি নয়, সেই সময়ের প্রগতিশীল ভাবনা-চিন্তা ধারণ করতেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এটা হলো প্রাপ্তি। বাঙালি জাতি এই ইতিহাসের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। এটা একটা বড় প্রাপ্তি।
১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হন, ৩ লাখ নারী ধর্ষিতা হন, ১ কোটি শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে কলকাতা গিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় দিন কাটান। ওই সময়ে পাকিস্তানের ২০-২৫টি সামন্ত জমিদার পরিবার পাকিস্তানি সামন্তীয় সরকার পরিচালনা করতো। তাদের সাথে সামরিক বাহিনীর যোগসাজশ ছিল। এদের সঙ্গে যোগসাজশ ছিল আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের। এসব বিষয় ইতিহাসে পরিষ্কার করে লেখা আছে। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই যে ত্যাগ স্বীকার হলো তার মূল লক্ষ্য ছিল শোষণহীন মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, ওই সময়ে ল্যাটিন আমেরিকা, ভিয়েতনামে যেসব সরকার প্রধানরা অত্যাচার করছিলেন সে সমস্ত অত্যাচারের বিরুদ্ধেও ছিল এটি একটি জবাব। সকলের ধারণা ছিল ১৯৭১ সালের পরে শোষণহীন মানবিক একটা সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে। যারা ভিয়েতনামে অত্যাচারের শিকার জনগণের পক্ষে দাঁড়াবে। কিন্তু সেটা তো হয়নি। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। পথ-ঘাট, ব্রিজ, অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়া একটি রাষ্ট্র।
একাত্তর থেকে পঁচাত্তরের অর্ধেক পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের সরকার ভেঙেপড়া একটা রাষ্ট্রকে গোছানোর জন্য খুব একটা সময় পেলো- তা কিন্তু না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে গুছিয়ে নেওয়ার সময়ও তারা পায়নি। তারপর গতানুগতিক ধারায় চলে গেল, যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেলো তা আসলে পাকিস্তানি ছিল। যেটার বিরুদ্ধে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্ররা লড়াই করলো। আমরা দেখলাম, জিয়াউর রহমান, এরশাদের হাত ধরে আবার সেই রাষ্ট্রই ফিরে এলো এবং খালেদা জিয়াও তাই করেছেন। শেখ হাসিনাও পুঁজিবাদী রাজনীতিকেই সমর্থন দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে ঐতিহ্য সেটা মুক্তিযুদ্ধ ঘেঁষা। আওয়ামী মুসলিম লীগ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা একটি সংগঠন। সুতরাং এদের লম্বা ঐতিহ্য। এজন্য বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ অনেক অনেক আলাদা। কিন্তু আমরা আসলে ওই রাষ্ট্রটা পেলাম না। ওই মানবিক সমাজটা পেলাম না, যেটা শোষণমুক্ত, যার ব্যক্তি স্বাধীনতা, গোষ্ঠী স্বাধীনতা (নৃতাত্ত্বিক যে গোষ্ঠীগুলো আছে তাদের স্বাধীনতার কথা বলছি) রয়েছে। সহজ বাংলায় বলতে চাই- অসাম্প্রদায়িক সমাজ- এটাই হচ্ছে অপ্রাপ্তি।
খুব রাজনৈতিক প্রত্যাশা ছিল, যা আমরা কয়েক বছর আগেও বলে বেড়াতাম। কিন্তু এখন আর সেটা হবে না, আমরা জানি। তবে চাই, দেশে একটি শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা হোক। সেটা এখনই না হোক, দশ-বিশ বছরের মধ্যে হলেও হোক। এই স্বপ্ন আমার বাবা দেখেছিলেন। আমার এটা বলতে লজ্জা নেই যে, আমি কমিউনিস্ট সমাজের স্বপ্ন দেখতে চাই বা সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর অর্থনীতি দেখতে চাই। দেশে বাম ঘরানার রাজনৈতিক পার্টিগুলো লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি করে মার্ক্স, অ্যাঙ্গেল, লেলিনকে একদম সত্তার মধ্যেই শেষ করে দিয়েছে। এখন রাজনৈতিক নেতাদের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ইত্যাদি দেখতে পাচ্ছি। এগুলোর পেছনের কারণ আমাদের দেশে অসুস্থ রাজনীতির সংস্কৃতির চল, যা ১৯৭৫ সালের পর শুরু হয়। আর সেটাই এখনো মেনটেন করে আসছে। নতুন প্রজন্ম যারাই রাজনীতিতে এসেছে, তারাই অপসংস্কৃতির ভেতর দিয়ে বড় হওয়া প্রজন্ম। ফলে একজন শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম, জহির রায়হান, ওসমানী, খালেদ মোশাররফ হওয়ার মতো বাস্তবিক কোনো পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এই প্রজন্ম বড় হয়নি। বরং একজন সুবিধাবাদী মওদুদ আহমেদ, একজন সুবিধাবাদী মিজানুর রহমান হওয়ার মতো পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে তারা বড় হয়েছেন। তারপরও এ পর্যায়ে একটা বিষয় চাইতে পারি, যা বর্তমান সরকার বাস্তবায়ন করতে পারে- আর তা হলো শিক্ষাব্যবস্থা।
আমাদের প্রজন্ম, ডা. মুরাদের প্রজন্ম— এসব প্রজন্মের পক্ষে কিছু করার উপায় নেই। কারণ আমরা সুবিধাবাদী হয়ে গেছি। অথবা আমরা পূর্ণাঙ্গ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোরে পরিণত হয়েছি। সুতরাং এখনই শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। আর এটা আওয়ামী সরকার শেখ হাসিনাই পারেন। এই শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে একমুখী। গ্রামে-শহরে মাদ্রাসা, ইংরেজি মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়ামে একটি মাত্র শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে। মাদ্রাসায় আরবি পড়ানো হবে, সেই সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রামের ছেলেমেয়েরা যে কোর্সগুলো বাংলা বা ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ে সেগুলো মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও পড়বে। মুহাম্মদের জীবনী পড়বে, সেই সঙ্গে লিও তলস্তয়ের জীবনীও পড়তে হবে। এখনি যদি এমন একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে পারি, তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম একই রকম শিক্ষা-চেতনা নিয়ে বড় হবে।
যে ছেলেমেয়ে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকবে, তার জন্য রাজনীতি উন্মুক্ত করে দিতে হবে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা যাবে না। একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য থেকে যে ছেলেমেয়ে কলেজে এসে পছন্দমতো রাজনীতি করার সুযোগ পাবে তার রাজনৈতিক চেতনা-ভাবনা অনেক স্বচ্ছ হওয়ার কথা। আর এই একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও থাকতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে সচিবের পদমর্যাদা দিতে হবে। একজন সচিব যে বেতন পান, সামাজিক যে পদমর্যাদা নিয়ে চলেন, সরকার তাকে যেভাবে বাড়ি-গাড়ি দেয়, প্রত্যেক স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে ঠিক ততটাই পদমর্যাদা, সামাজিক, আর্থিক সুবিধা দিতে হবে। সেই সঙ্গে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। কোনো শিক্ষক রাজনীতি করতে পারবেন না। এগুলো আমার ব্যক্তিগত ভাবনা, কোনো সংগঠনের নয়। এগুলোই জাতিগঠন।
এখন যে প্রজন্ম বড় হচ্ছে তাকে যদি ঠিকঠাক মতো বড় করতে পারি, তাহলে আমি আশা করতে পারি আগামী ২০৩০-৩৫ এ গিয়ে এই প্রজন্ম যখন চাকরি বা ব্যবসায় পা দেবে তখন তারা অনেক ভালো একটি ফল নিয়ে আসবে। তখন তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা করবে। সংবিধানে সামাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ লিখে দিলেই হলো না। এটা ধারণ করতে হবে। জোর করে বহন করানো যায় না। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে আমি চাই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হোক।
লেখক: শহীদ বুদ্ধিজীবী চলচ্চিত্রকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার জহির রায়হানের সন্তান