বর্তমানে ‘জল্লাদখানা’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া জায়গাটি একাত্তরে ছিল প্রায় বিরাণভূমি। মিরপুর-১০ এর এই জায়গাটিতে ছিল ওয়াসার পরিত্যাক্ত পাম্প হাউস। ঘাতকেরা হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর মৃতদেহের শেষ চিহ্ন চিরতরে মুছে ফেলার জন্য এই পাম্প হাউসকেই বেছে নিয়েছিল। এভাবেই সেই বিরাণভূমি হয়ে উঠেছিল বধ্যভূমিতে।
যারা স্বজন হারিয়েছিলেন তারা আর দেখতে পারেননি প্রিয় মুখগুলো। মৃতের মাথায় শেষ যাত্রায় স্পর্শ করেনি কোনো ভালোবাসার পরাগমাখা হাত। মৃতদেহের দিকে কেউ গভীর পলক ফেলে তাকিয়ে থাকার সুযোগও পায়নি। চোখের দৃষ্টি থেকে শুধু নয়, সূর্যের আলো যেন তাদের নাগাল না পায় এতো গভীরে, জলঘেরা গর্তে সেদিন চাপা দেওয়া হয়েছিল তাদের লাশ।
বিস্মৃতির অতলে চাপা পড়া লাশগুলো বের হয়ে আসতে থাকে ২৮ বছর পর যখন ১৯৯৯ সালে সেখানে খনন কাজ শুরু হয়। সবাইকে হতবাক করে ঘরের ভেতর ভূগর্ভস্থ চৌবাচ্চা থেকে ৭০টি মাথার খুলি এবং চারশ’র বেশি অস্থিখণ্ড পাওয়া গিয়েছিল। উদ্ধার হওয়া অস্থি আর মাথার খুলির সঙ্গে ২৮ বছর পর বাইরের আলোয় উঠে আসে ছিন্নভিন্ন পোশাক, সস্তা প্লাস্টিকের জুতা, তসবি, মালা, চুলের কাঁটা, মানিব্যাগ ইত্যাদি।
মাথার সবগুলো খুলি দেখতে একই রকম। ততদিনে এরা সবাই মিলে এক অখণ্ড যুদ্ধের দলিলে পরিণত হয়েছে যেন। খনন কাজ শুরু হবার পর স্বজনহারা মানুষ ছুটে এসেছিলেন জল্লাদখানায়। তারপর থেকে, সেদিনের পর থেকে এই স্মৃতিপীঠে প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী আসে। খুলি উদ্ধার হওয়ার জায়গাটিতে চৌবাচ্চার উপর কাচের পাটাতনে লাল অক্ষরে লেখা ‘মাথা নত করে শ্রদ্ধা নিবেদন করি সকল শহীদের প্রতি’।
এখানে এসে মাথা নিচু করে দেখতে পাওয়া যায় পানির বুদবুদ স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ক্রমে আলোকচ্ছটায় মিশে উপরে উঠে আসে। উঠে আসে ইতিহাসবোধ, বেদনাবোধ। প্রতিদিন এখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন মানুষ। তারা ফিরে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে যান বিস্ময়, ক্রোধ এবং একটি প্রশ্ন- কী ঘটেছিল সেদিন এখানে?
এ প্রশ্নের তাড়নায় হাজির হই এমন এক মানুষের কাছে যিনি তার পিতা ও দুই ভাইকে হারিয়েছেন সেই বধ্যভূমিতে। নাম আফসার উদ্দীন। তিনি বললেন, ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের ৯ তারিখ, দুজন বিহারী এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো- তোর আব্বা বাসায় আছে? বললাম আছে। তারপর দেখলাম ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল। দৌড়ে বাবাকে গিয়ে বললাম- বিহারী আসতাছে আপনি দৌড় দেন। এর মধ্যে দুজন বিহারী ছিল তারা আমার উদ্দেশ্যে একজন আরেকজনকে আদেশ দিলো- ‘ইসকোভি পাকরাও’।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া ১৩ বছরের কিশোর আফসার উদ্দীন তখন দৌড়ে পাশের বাড়ির শৌচাগারে আশ্রয় নেন। মিরপুর ১১ নম্বর রোডের ১৫ নম্বর লেনে অবস্থিত ৫ নম্বর বাসাটিতে তখনও কালো পতাকা উড়ছিল। এ পাতাকা উত্তোলনের কারণ ছিল ২৫ মার্চের প্রতিবাদের প্রতীক। পতাকা উড়তে থাকলো, বিহারীরা ধরে নিয়ে গেলো আফসার উদ্দীনের পিতা মওদুদ আলী মোল্লা, দুই ভাই শহীদুল্লাহ মোল্লা এবং আজীজুল্যাহ মোল্লাকে। আফসার উদ্দীন জানান সেদিনের সেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল স্থানীয় বিহারীরা। তাদের সঙ্গে সেদিন পাকসেনা ছিল না।
কিশোর আফসার উদ্দীন জানতেন না বাবা আর বড় ভাইদের সঙ্গে সেই দেখাই তার শেষ দেখা। গল্পের শেষ এখানেও না। তারা বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন আত্মীয়ের বাড়িতে। বাড়ি ফিরে আসেন প্রায় এক বছর পর। এই সময়ের মধ্যে বাড়ির ৪০টি গরু, গোলার ধান-চাল সব লুট হয়ে গিয়েছিল।
সেদিনের দুষ্কৃতিকারীদের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে আর দেখা হয়েছে? আফসার উদ্দীনের উত্তর- না দেখা হয় নাই। আফসার উদ্দীনের চোখের কোণায় চিকচিক করে পিতা হারানো, ভাই হারানোর বেদনা আর গৌরববোধ। দেশের মুক্তির জন্য তার পরিবারের আত্মত্যাগের গল্প তাকে শক্তি জোগায়।
এই স্মৃতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় জল্লাদখানা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, ১৯৭১ সালে মিরপুর অঞ্চলে অবাঙালি অধিবাসীদের যুদ্ধাপরাধের কাজে ব্যবহার করার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি তৎপর ছিল। তাদের অমানবিক অপরাধের সঙ্গে যারা যুক্ত হয়েছিল তারা অবশ্যই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী এবং তাদের চিহ্নত করা দরকার। মানবতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সম্প্রীতির সমাজ গড়ার জন্য সেসব অপরাধীদের ন্যায়বিচারের মুখোমুখি করা দরকার। আমাদের লক্ষ্য এই স্মৃতিস্থানটুকু ঐতিহাসিক ঘটনাস্থল হিসেবে না দেখে দেশের মানুষ, এর দর্শনার্থীদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্র তৈরি হোক। তারা যেন বধ্যভূমি সম্পর্কে জেনে মানবতার বিরুদ্ধে যে ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার ক্ষত উপশম করে সমাজে সমন্বয় আনার চেষ্টা করে, সমাজে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়।
স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইনের সার্বিক পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রচেষ্টায় তৈরি করা হয় জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ। এই স্মৃতিপীঠের ছবি কক্ষে উদ্ধারকৃত অস্থি, খুলির পাশাপাশি স্থান পেয়েছে উদ্ধার করা পোশাকের টুকরো, জুতো, সাইকেলের চেইন যা হত্যার শিকার মানুষের অতীতের সজীব জীবন প্রকাশ করে।
জল্লাদখানায় ঢুকেই স্মৃতিউদ্যানে ধীরে ধীরে বামপাশ ধরে হেঁটে ডান পাশ হয়ে চৌবাচ্চার কাছে গিয়ে দাঁড়ানো যায়। এই হাঁটা পথে শ্বেতপাথরে লেখা সারাদেশের বিভাগ অনুযায়ী বধ্যভূমিগুলোর নাম। তার পাশেই সংরক্ষণ করা বধ্যভূমির মাটি। এই মাটি মনের গভীরে ক্রমে নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞের কথা মনে করিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার প্রতি গভীর মমত্ববোধের বীজ বুনে দেয়। তারপর চৌবাচ্চার সামনে দাঁড়িয়ে গাঢ় ও গভীর নিস্তদ্ধতায় পূর্বপুরুষদের সঙ্গে কথোপকথন। একে অন্যকে যেন প্রশ্ন করা- কে তুমি? তারপর স্মৃতিধারণকারী হননকক্ষে ঘণ্টা বাজিয়ে সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা নিচু হয়ে প্রবেশ করা। ঘুরে দেখা। না দেখা আরও অধিক। সেই ভারী হওয়া মন ও শরীর নিয়ে চারপাশ খোলা কক্ষে বসার ব্যবস্থা আছে। সেখানে শহীদদের সম্পর্কে অনেক তথ্য যেমন মিলবে, তেমনি নিজের মন্তব্যও লিখে আসা যাবে মন্তব্যের খাতায়। ফেরার সময় প্রশ্ন এই- ‘জাতি নিধনের বিচার কবে হবে?