মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক ইকবাল। একাধিক অপারেশনে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।
১৯৭১ সালে আমি ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। ২৬ মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকেই আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। জুলাই মাসে আমরা ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যাই। শিলিগুড়ি পানিঘাটায় আমরা প্রশিক্ষণ নিয়েছি। বলছিলেন জহুরুল হক। বগুড়ার সারিয়াকান্দি থেকে ডিঙি নৌকায় যমুনা নদীপথে যাত্রার সময় গাইবান্ধার ফুলছড়ি এলাকায় আমরা দূর থেকে দেখতে পাই ৪-৫ টা স্পিডবোট নিয়ে পাকসেনারা আক্রমণ করছে। আমরা দ্রুত নদীর পাড়ে নৌকা ভিড়িয়ে আত্মগোপন করি। সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম।
বগুড়ার এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, আমার যুদ্ধ জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন ২৪ নভেম্বর। ওই দিন আমরা ২০০ পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে যুদ্ধ করি। ঘটনাটি ঘটেছে কালেরপাড়া গামে। এটি ধুনট থানা হেড কোয়ার্টার থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে। গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতি। পাকসেনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং ভীতির কারণ ছিল গ্রামটি। কারণ ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এই গ্রামের কৃতি সন্তান ডা. গোলাম সারওয়ার। পাক হানাদারদের ধারণা ছিল এ গ্রাম থেকেই গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধের ছক পরিচালনা করা হয়। গ্রামটিতে তারা দুইবার আগুন দিয়েছিল। আমাদের দলের শেল্টার ছিল নদীর ওপারে কালেরপাড়া ইউনিয়নের সুলতানাহাটা গ্রামে। কালেরপাড়া থেকে এই গ্রামের দূরত্ব দুই কিলোমিটার। দুই গ্রামের মাঝখানে ইছামতি নদী থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গ্রামটি ছিল নিরাপদ।
আমরা ২৩ নভেম্বর বিকালে সুলতানহাটা গ্রামে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এমন সময় কালেরপাড়া গ্রাম থেকে কয়েকজন ব্যক্তি এসে তাদের গ্রামে খাবারের কথা বলে। যে কারণে সন্ধ্যায় আমাদের দল থেকে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ কালেরপাড়া যায়। রাতে খাওয়া শেষে যখন আমরা ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি আমাদের কাছে অনুরোধ করে রাতে থেকে পরদিন রাতে যাওয়ার জন্য। কারণ তাদের কাছে খবর ছিল পরদিন ২৪ নভেম্বর গ্রামটিতে পাকসেনারা আবারও আক্রমণ করতে পারে। তাদের অনুরোধে আমরা সেখানে থেকে যাই। একজনকে পাঠিয়ে দেই বাকিদের প্রস্তুতি নিয়ে আসার জন্য।
পরের রাতে আমাদের কারো চোখে ঘুম নেই। শত্রুপক্ষের আক্রমণের আশঙ্কায় আমরা প্রহর গুণতে লাগলাম। রাত গড়িয়ে ভোর হলো। কিন্তু সকাল ৮টা পর্যন্ত আক্রমণের লক্ষণ বোঝা গেলো না। আমরা ভাবলাম পাকসেনারা বোধহয় আক্রমণ করবে না। হঠাৎ তারা গ্রামে আক্রমণ করে বসলো। তখন আনুমানিক সকাল ৯টা। তারা আমাদের কথা জেনেই এসেছিল। কিন্তু আমরা প্রস্তুত থাকায় তুমুল গোলাগুলি শুরু হলো। তিনভাগে বিভক্ত হয়ে চললো আক্রমণ। এর মধ্যে আমাদের আরো ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা যাদের গত রাতে খবর পাঠানো হয়েছিল তারাও এসে যোগ দেয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ১০ ঘণ্টা পাকসেনাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ চলতে থাকল। সন্ধ্যায় আঁধার ঘনিয়ে এলে পাকসেনারা যখন বুঝতে পারলো অন্ধকারে তারা কেউ বেঁচে ফিরে যেতে পারবে না তখন পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেদিন যুদ্ধে শত্রুপক্ষের তিনটি লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। কয়েকটি লাশ তারা নিয়ে গেছে বলে জানতে পারি। এরপর তারা ধুনট থানা হেড কোয়ার্টারে ফিরে যায়। আমরা থানা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করি। কিন্তু মাঝে রাতেই তারা বথুয়াবাড়ী ঘাট হয়ে বগুড়া শহরের দিকে চলে যায়।