শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশন করছে শিক্ষার্থীরা। এর আগে উপাচার্যকে পদত্যাগের জন্য তারা সময় বেঁধে দিয়েছিল। তারা উপাচার্যের অপসারণ চেয়ে আচার্য বরাবর আবেদনও জানিয়েছে।
অন্যদিকে ১৬ জানুয়ারি পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ অজ্ঞাত প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা পুলিশের ওপর গুলি ছুড়েছে। শিক্ষার্থীদের হল ক্যাম্পাস ছাড়তে বলা হলেও তারা ক্যাম্পাস ছাড়েনি বরং আন্দোলন জোরদার করেছে। তাদের সমর্থনে দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছে।
ঘটনার সূত্রপাত বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের অসদাচরণ নিয়ে। ১৩ জানুয়ারি রাতে ওই হলের ছাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণ করায় ছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করে। ১৫ জানুয়ারি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা আন্দোলনরতদের ওপর হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। বলাবাহুল্য এতে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখে। এরপরই ভিসিকে মুক্ত করতে অ্যাকশনে যায় পুলিশ। তাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে এবং অর্ধ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়।
এখানে লক্ষ্যনীয় হলো, শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু হলেই ভিসি বা প্রক্টরকে আটকে রাখে- এই মানসিকতা ঠিক নয়। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। অথচ তারা কি জানে না- রাজনীতির ছকে ভিসি বা প্রক্টর কতোটা বন্দি থাকেন। এ সময়ে এসে তারা অনেক আগেই ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দারে’ পরিণত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গনে পুলিশ ডেকে এনে শিক্ষার্থীদের দমানোর কৌশল বা সরকারি ছাত্র সংগঠনের সাহায্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো আন্দোলনকে দমানো ছাড়া তাদের আপাতত কোনো কাজ আছে বলে মনে হয় না।
অবশ্য উপাচার্য বলেছেন, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে তিনি মেনে নেবেন। অর্থাৎ উপাচার্য সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজী, যদিও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং অবশ্যই জ্ঞানের আলয়। সমাজের সবচেয়ে মেধাবী, জ্ঞানী-গুণী, দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সিদ্ধান্তে এসব প্রতিষ্ঠান চলার কথা। অথচ তিনি নিজেই চাইছেন এই স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে সরকার হস্তক্ষেপ করুক। এখানে তাহলে সরকারকে আর দোষ দিয়ে লাভ কি? রাজনীতিকে দোষ দিয়ে লাভ কি? চেয়ার সামলাতে তাদের সরকারি ছাত্র সংগঠনের ছায়াতলে থাকার কথা না হয় বাদই দিলাম!
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলমান দুর্নীতি, অস্থিরতা, রাজনৈতিক খেলা, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এক হতাশাব্যাঞ্জক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সেই হিসেবে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলার প্রস্তাব সমর্থন করা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ, ইউজিসি এবং সর্বোপরি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিশেষভাবে অনুরোধ করব ভিসি নিয়োগে প্রকৃত শিক্ষানুরাগী শিক্ষকদের বেছে নিতে। ভিসিরা একক ক্ষমতার অপব্যবহার করে পদের সম্মান নষ্ট করছেন। তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষক, কর্মচারী, কর্মকর্তা নিয়োগ ও বিভিন্ন আর্থিক বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রিয়তা ও অর্থিক সম্পৃক্ততা, একাডেমিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি ইত্যাদি এখন সাধারণ খবরে পরিণত হয়েছে। সেখানে প্রশাসনের এই দুরবস্থার সুযোগ নিচ্ছে ছাত্রনেতারা। তারা প্রশাসনের দুর্নীতির চিত্র দেখে নিজেরাই অনেক কিছু হাতে নিয়ে নেন। তখন মেরুদণ্ডহীন প্রশাসনের আর বেশি কিছু করার থাকে না।
প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ধরনের শিক্ষক আমরা নিয়োগ দিচ্ছি? এই ধারা তো একদিন বা দুদিনে তৈরি হয়নি। তারা কেন ভুলে যাচ্ছেন- যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ অধিকতর মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত ও সম্মানিত। তাদের কোনভাবে কলঙ্কিত করার সুযোগ তৈরি হতে দেওয়া উচিত নয়- বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে। এখানে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রয়োজন উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার জন্য, দেশকে দক্ষ জনশক্তি উপহার দেওয়ার জন্য যাতে তারা জাতির সেবা করতে পারে সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে। অথচ রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ভিসিদের কারণেই মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্ত্বশাসন ভোগ করতে পারছে না। অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডিন, প্রো-ভিসি ও ভিসি তো কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য পদে বসেন না। তারা সবাই সম্মানিত শিক্ষক। তাদের নির্বাচনের মাধ্যমে পদে কেন বসতে হবে? কেন তাদের নীল, সাদা কিংবা গোলাপী দলকে জেতানোর জন্য দলে লোক ভারী করতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোটের সময় এলে শিক্ষকদের দৌড়-ঝাপ, ব্যস্ততা দেখে মনে হয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচন! এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে আজ হোক আর কাল হোক বিদেশীরা এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খুলবে এবং শিক্ষা বাণিজ্য করবে।
এখন ভিসি নিয়োগের যে পদ্ধতি তাতে রাজনীতি না করে শিক্ষকদের উপায়ও নেই। সিন্ডিকেট বা সিনেটের সদস্যরা যদি ভোট দেন তাতে কোনো অধ্যাপক ভিসি হতে পারছেন না। তিনজন উর্ধ্বক্রমের অধ্যাপকের মধ্যে একজন ভিসি হবেন। তাকে নিয়োগ দেন চান্সেলর। পার্টির আগ্রহের বাইরে যেসব অধ্যাপকদের অবস্থান তারা যত বড় গবেষকই হোন না কেন, যত বড় অধ্যাপকই হোন না কেন, ভিসি হতে হলে যে পার্টি যখন ক্ষমতায় সেই পার্টির স্তুতি গাইতে হবে। এখন নিজেদের কাছেই যদি আমরা প্রশ্ন করি- এই পদ্ধতিতে ভিসি নিয়োগে দেশ কতটা উপকৃত হচ্ছে? উত্তর মিলবে না। অথচ যা ঘটছে আমরা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছি। এই লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক