গাজীপুরের শ্রীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে চলতি মাসে ধারাবাহিকভাবে ৯টি জেব্রার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে চারটি মারামারি করে ও পাঁচটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে মারা গেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) বিকেলে সাফারি পার্কের ঐরাবতি বিশ্রামাগারে মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে প্রাণী বিশেষজ্ঞ ও গবেষক দলের মধ্যে বৈঠকের আয়োজন শেষে এ কথা জানানো হয়।
গত ২ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত এ পার্কে ৯টি জেব্রার মৃত্যু হয়। নেতিবাচক পরিস্থিতির কথা ভেবে পার্ক কর্তৃপক্ষ তা জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি। ৯টির জেব্রার মৃত্যুর পর এখন পার্কে জেব্রার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০টিতে।
এসব প্রাণীর মৃত্যুর পর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়। পরে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নমুনা ঢাকার মান নিয়ন্ত্রণ গবেষণাগার ও ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পাঠানো হয়েছিল। এরই মধ্যে এর প্রতিবেদন এসেছে। বিশেষজ্ঞরা প্রতিবেদনের আলোকে মৃত্যুর সঠিক কারণ ব্যাখ্যা করেন।
বিশেষজ্ঞ দলে ছিলেন- জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর ডা. এ বিএম শহীদ উল্লাহ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি অনুষদের অধ্যাপক ড. মো.আবু হাদী নুর আলী খান, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল আলম, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, গাজীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এসএম উকিল উদ্দিন ও সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি কর্মকর্তা ডা. হাতেম সাজ্জাত জুলকারনাইন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অনুষদের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল আলম বলেন, মৃত পাঁচটি জেব্রার মরদেহে পাঁচ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যা হলো স্টেপটোকোক্কাস, পাস্টোরেলা, সালমোনিলা, ইকোলাই ক্লোসটেডিয়াম। যেকোনোভাবেই মারা যাওয়া জেব্রাগুলো এসব ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত হয়েছে। যেহেতু উন্মুক্ত অবস্থায় এসব প্রাণীগুলো বিচরণ করে থাকে।
জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর ডা. এ বিএম শহীদ উল্লাহ বলেন, সুদূর মানিকগঞ্জ থেকে ঘাস এনে জেব্রার খাবার হিসেবে সরবরাহ করা হয়। সেখানকার ঘাসও পরীক্ষা করে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। তাই বর্তমানে অবশিষ্ট যে প্রাণীগুলো সাফারি পার্কে আছে তাদের সুস্থতায় বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি বাকি প্রাণীগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পারবো। পর্যবেক্ষণগুলো হচ্ছে- জেব্রার বসতির জায়গার মাটি ওলট পালট করে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে জীবাণু ধ্বংস করতে হবে, সাফারি পার্কের জলাধারের পানি পরিবর্তন করতে হবে, জেব্রাগুলোকে টিকার আওতায় আনতে হবে, জেব্রার খাবার হিসেবে পরিপক্ব ঘাসের ব্যবস্থা করতে হবে, শুকনা খাবার ফাঙ্গাসমুক্ত করে পরিবেশন করতে হবে, ঘাস পানিতে ভালো করে ধৌত করে কেটে পাত্রে পরিবেশন করতে হবে, এসব প্রাণীর বেষ্টনীতে বায়োসিকিউরিটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, অতিরিক্ত নিরাপত্তা কর্মীর ব্যবস্থা রাখতে হবে, পার্কের অভ্যন্তরে পতিত জমিতে ঘাস উৎপাদন করে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে, নাইট ভিশন ক্যামেরাসহ পুরো বেষ্টনীতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, বাকি প্রাণীগুলোকেও নজরদারি করা হচ্ছে। তাদের খাবারের সঙ্গে নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া প্রতিদিন মলসহ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।
সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবির বলেন, হঠাৎ করেই এ প্রাণীগুলো অসুস্থ হয়ে পড়ে। মারা যাওয়া জেব্রাগুলোর সিংহভাগই হচ্ছে মাদি।
তিনি আরও বলেন, সাফারি পার্কের বিশাল এলাকাজুড়ে জেব্রার বসতি। জেব্রার চারণভূমিতে রয়েছে কৃত্রিম লেক ও চারণ ভূমি। উন্মুক্ত অবস্থায় বিচরণ করে জেব্রা। তাদের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীরও বিচরণ রয়েছে। প্রতিবছর প্রজননের সময় হলে জেব্রাগুলো একে অপরের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। এ সময় বড় ধরনের ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই মারা যায়। এভাবে পার্কে চারটি জেব্রার মৃত্যু হয়েছে।
সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান বলেন, হঠাৎ করে এভাবে প্রাণিগুলোর মৃত্যু খুবই কষ্টকর। নিজের হাতে লালন পালনের পর চোখের সামনেই এদের মৃত্যু দেখতে হলো। এখানে আমাদের কারও কোন ধরনের গাফিলতি ছিল না।