তিনি প্রাচ্যের অক্সেফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নশাস্ত্রে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন একমাত্র তারাই জানেন রসায়নশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে সাহসের সঙ্গে কত চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। একাডেমিক পড়াশোনা শেষে কোনো এক পেক্ষাপটে নতুন বিষয়ে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হলো তার। আগ্রহের বিষয় ছিল শেয়ারবাজার। সেই থেকে শুরু হলো শেয়ারবাজার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া এবং জানা। তারপর বিনিয়োগ শুরু করলেন শেয়ারবাজারে। এক পর্যায়ে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্য পদ নিলেন। একজন নারীর পক্ষে এই পথ পাড়ি দেওয়া খুব সহজ নয়। চলার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে দিয়ে সাহস নিয়ে এগিয়ে চলেছেন তিনি। মনোনীত হয়েছেন ডিএসইর পরিচালক। পরবর্তীতে মনোনীত নয় সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে পরিচালক পদে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শেয়ারবাজারে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি হলেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক নির্বাচিত পরিচালক এবং মডার্ণ সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি)।
রাইজিংবিডিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নারীর সক্ষমতা, ক্ষমতায়ন, শেয়ারবাজারে নারীর অংশগ্রহণসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাজমুল ইসলাম ফারুক।
রাইজিংবিডি: শেয়ারবাজারে নারীর অংশগ্রহণ সম্পর্কে বলুন। খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): আসলে শেয়ারবাজারে নারীর অংশগ্রহণ সেভাবে নেই। খোঁজ করলে শুধুমাত্র প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিওতে) তাদের অংশগ্রহণ কিছুটা থাকলেও সেকেন্ডারি মার্কেটে যে পরিমাণ নারী অংশগ্রহণ করার কথা ছিল সেটা হচ্ছে না।
রাইজিংবিডি: শেয়ারবাজারে নারীদের বিও হিসাব কমছে কেন? খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): কাগজে কলমে নারীদের যে পরিমাণ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব ছিল প্রকৃতপক্ষে ততটা নয়। তারা পুরুষ বিনিয়োগকারীদের আত্মীয়স্বজন ছিল। মূলত এসব বিওধারীরা প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) অংশগ্রহণ করতো। এখন আইপিও সিস্টেমের পরিবর্তন হয়েছে। ফলে প্রায় ২ লাখ নারী বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব ঘাটতি দেখছেন। মূলত তারা ছিল আইপিও ক্লায়েন্ট।
রাইজিংবিডি: শেয়ারবাজারে নারী বিনিয়োগকারী না আসার কারণ কী? খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): অনেকটা মনে করেন এটা পুরুষের কাজের ক্ষেত্র। এখানে পুরুষরাই বিনিয়োগ করবে, কাজ করবে। আবার অনেকে মনে করেন নারীদের এখানে নিরাপত্তা নেই, এটা ভুল। এই ভুলের কারণেই নারী বিনিয়োগকারী না আসার অন্তরায়। শেয়ারবাজার নারীদের জন্য একটা নিশ্চিন্ত নিরাপদ জায়গায় সেটা অনেকে বুঝেন না।
তাছাড়া নারীদের টাকা যোগাড় করা, ঘর থেকে বেরিয়ে শেয়ারবাজারে আসতে এখনো অনেক প্রতিবন্ধতা রয়েছে। অপরদিকে, গত কয়েক বছর ধরে মার্কেটের অবস্থা ধারাবাহিকভাবে উন্নতি হচ্ছে না। ২০২১ সালের শুরুতে মার্কেট ভালো ছিল এখন আবার নিম্নমুখি। মার্কেটের অবস্থা ভালো থাকলে নারীদের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বাড়বে।
রাইজিংবিডি: নারীর অংশগ্রহণ কীভাবে বাড়ানো যায় বলে মনে করেন? খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): নারীদের অংশগ্রহণ অন্যান্য খাতে বেড়েছে। আগের চেয়ে নারীরা এখন অনেকটা স্মার্ট। তারা পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তবে মার্কেট ভালো হলে এমনিতেই নারী বিনিয়োগকারী বাড়বে।
রাইজিংবিডি: নারী বিনিয়োগকারীদের আলাদা বুথ বা প্রশিক্ষণ দিলে তারা আগ্রহী হবেন? খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): আমার হাউজে নারী বিনিয়োগকারীদের জন্য আগে আলাদা বুথ করেছিলাম। তখন নারীরা সেই বুথে না বসে পুরুষদের সঙ্গে বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা পরামর্শ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে দেখেছি। একপর্যায়ে নারীদের অনাগ্রহের কারণে সেই বুথ রাখতে পারলাম না। আমার মনে হয়, নারীরা পুরুষদের সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে বিনিয়োগ করতে, ব্যবসা করে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া আমি মনে করি না যে, নারীদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে।
রাইজিংবিডি: অন্যান্য খাতের চেয়ে শেয়ারবাজারে নারীর অংশগ্রহণ অনেকটা পিছিয়ে আছে, কিভাবে সেটা বাড়ানো যায়? খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীরা এখনো মনে করে বাবা, ভাই, স্বামী যা করছে সেটাই ভালো। তাছাড়া শেয়ারবাজার মানে ঝুকি নিতে হয়। নারীরা ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। এসব চিন্তা করে নারীরা শেয়ারবাজারে আসছে কম। তাছাড়া শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার জন্য যে পরিমাণ আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন সেভাবে তা আমরা তৈরি করতে পারছে না। যদি বাজার গতি ফিরে পায় তাহলে নারীরা এখানে আসবে। মার্কেট ভালো থাকলে আগামী ৫ বছর পর দেখা যাবে নারীর অংশগ্রহণ কয়েকগুণ বেড়েছে।
রাইজিংবিডি: শেয়ারবাজার সম্পর্কে নারীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন। খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): আসলে যে সময় ক্যারিয়ার গড়ার কথা তখন নারী বা পুরুষের বিয়ে ও সংসার করতে হয়। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে সমস্যা হয় যখন সে মা হয়ে যায়। তখন তার ওপর অনেক দায়িত্ব পড়ে। এ কারণে পড়াশোনায় তারা যত ভালো করুক ক্যারিয়ারে বা কর্মক্ষেত্রে তারা ততটা ভালো করতে পারে না। একটাই সমস্যা সন্তানের পিছুটান, পারিবারিক পিছুটান তাদের ওপর রয়ে যায়। সেক্ষেত্রে আমি বলব অনেক মেধাবী নারী আছে যারা ক্যারিয়ার গড়তে পারেনি, একটা সময় তারা বুটিক্স করতে চায়। আমি বলবো শিক্ষিত মেধাবী নারীদের শেয়ারবাজারে আসা উচিত। মেধাবী অনেক নারীরা জানেন না, তারা শেয়ারবাজারে কিছু একটা করতে পারবে। এটা একদিকে তাদের অজ্ঞতা, অক্ষমতা এবং বিপরীত দিকে নারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না শেয়ারবাজার সেটা আমাদের অপারগতা।