একাত্তরের ১০ মার্চ ছিলো বুধবার। এইদিন কালো হয়ে উঠেছিলো ঢাকার আকাশ। পুরো ঢাকা পরিণত হয়েছিলো কালো পতাকার শহরে।
স্বাধিকার আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ঢাকা নগরীর সকল বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, বাসভবন এমনকি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবন এবং রাজারবাগ এলাকায় অবস্থিত পুলিশ বিভাগের অফিসগুলোর শীর্ষেও কালো পতাকা উত্তোলিত ছিলো। এমন কী নগরীর বিভিন্ন সড়কে সকল প্রকার যানবাহনের সম্মুখেও ছিলো শোকের স্মারক ‘কালো পতাকা’।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ৭ মার্চে সূচিত পূর্ব ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তৃতীয় দিবস ছিলো আজ। সর্বাত্মক অসহযোগে কার্যত পুরো দেশ অচল হয়ে পড়েছিলো।
এদিন রাজধানী ঢাকায় সকল সরকারি, আধা-সরকারি বিভাগের কর্মচারী অফিসে যোগদানে বিরত থাকেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী বেসরকারি অফিস, ব্যবসা কেন্দ্র, স্টেট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক এবং সরকারি ট্রেজারিসহ বিভিন্ন ব্যাংক খোলা থাকে।
পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও। পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে সামরিক সরকারকে চাপ দিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করে। ইংরেজী দৈনিক ‘ দি পিপল’ পত্রিকায় সেদিন ভুট্টোর কার্যকলাপের সমালোচনা করা হয়। সেখানে অতিসত্বর জনপ্রতিনিধিদের কাছে শাসনভার বুঝিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
এইদিন নারায়ণগঞ্জের সাব জেলের ২২৩ জন কয়েদী পালিয়ে যায়। এ সময় পুলিশের গুলিতে ২ জন মারা যায় এবং ২৫ জন আহত হয়। এ ছাড়া গত ৩ ও ৪ মার্চে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে যারা আহত হয়েছিলো আজ তাদের মধ্যে এক কিশোর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই আজ শেষ কথা। বাংলাদেশের জনগণের নামে আমরা যে নির্দেশ দিয়েছি সেক্রেটারিয়েটসহ সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস-আদালত, রেলওয়ে, স্থল এবং নৌবন্দরসমূহে তা পালিত হচ্ছে। যারা মনে করেছিলেন, শক্তির দাপটে আমাদের ওপর তাদের মত চাপিয়ে দেবেন বিশ্বের কাছে আজ তাদের চেহারা নগ্নভাবে ধরা পড়েছে। বিশ্ব জনমতের কাছে তারা বাংলার নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর শক্তির নগ্ন প্রয়োগের যৌক্তিকতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। এতদসত্ত্বেও বিবেকবর্জিত সেই গণবিরোধী শক্তি তাদের সশস্ত্র পথই অনুসরণ করে চলেছে। তাদের সমর সজ্জা সমানে অব্যাহত।’
এদিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান ও তাহরিখ-ই-ইশতিকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অব) আসগর খান এদিন করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। এদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনবার দেখা করেন এবং উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একান্তে আলোচনা করেন।
ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবের ওপর কোনরূপ দোষ দেবার আমি কোন কারণ দেখি না। তিনি সঠিক এবং ন্যায্য ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ছাড়া তার পক্ষে অন্য কোন ভূমিকা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আমি তার এ অবস্থানকে সমর্থন করি।’
এদিন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নেন এবং তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করে জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার সিদ্ধান্তেই অফিস আদালত চালানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।