সাতসতেরো

একাত্তরের ১৪ মার্চ যে কারণে ইতিহাসে মাইলফলক

একাত্তরের ১৪ মার্চ ছিলো রোববার। অন্যদিকে দ্বিতীয় পর্যায়ের অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তম দিন। 

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতিকে ৩৫টি নির্দেশ দেন। 

বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের পক্ষে তাজউদ্দিন আহমেদ সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৪ তারিখ এই ৩৫টি নির্দেশনা প্রকাশ করেন। পরদিন ১৫ মার্চ অধিকাংশ খবরের কাগজে এ নির্দেশাবলী ছাপা হয়।

এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ায় এ বিষয়ে উলে­খ করে যে, শেখ মুজিবুর রহমানের এই নির্দেশনার পর পূর্ব পাকিস্তানের ওপর থেকে কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যায়।

নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ বইতে লিখেছেন, ‘১৪ মার্চ , ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৫টি নির্দেশ জারির মাধ্যমে কার্যত: বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) শাসনভার গ্রহণ করেন।’

প্রদত্ত নির্দেশে বলা হয়, বাংলাদেশের সর্বত্র কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের সেক্রেটারিয়েট ও দপ্তরসমূহ, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, হাইকোর্ট এবং অন্যান্য আদালতে হরতাল বর্ণিত নির্দেশানুসারে পালিত হবে। 

বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ডিসি এবং মহকুমা প্রশাসকগণ অফিস বন্ধ রেখে স্ব-স্ব এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকল্পে কাজ করবে। প্রয়োজন হলে উন্নয়নমূলক কাজসহ অন্যান্য কাজও করবে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে সহযোগিতা করবে। পুলিশ বিভাগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে, প্রয়োজনানুযায়ী আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাহায্য গ্রহণ করবে।  

এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। প্রায় দেড় ঘণ্টার এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামারুজ্জামান। 

আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। জনগণের সার্বিক স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বাংলার জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। এই ঐক্যবদ্ধ মুক্তিপিপাসু গণমানুষকে পৃথিবীর কোন শক্তিই দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’

এদিন অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহবান জানিয়ে সর্বসাধারণের উদ্দেশে এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন।

বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ ঐক্যবদ্ধ আপামর জনগণ সামরিক আইনের নিকট নতি স্বীকার না করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কাজেই যাদের প্রতি সামরিক আইনের সর্বশেষ আদেশ দেয়া হয়েছে তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, তারা যেন কোনপ্রকার হুমকির মুখে মাথা নত না করেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের ও তাদের পরিবারের পেছনে রয়েছে।’ 

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তি আকাক্সক্ষাকে নির্মূল করা যাবে না। আমরা অজেয়। কারণ আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। এবং প্রয়োজনবোধে আমাদের ভবিষ্যত বংশধররা যাতে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে স্বাধীন ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা মুক্তির লক্ষ্যে পদার্পণ না করব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম আরও পূর্ণোদ্যমে অব্যাহত থাকবে। আমি যে কোন আত্মত্যাগে প্রস্তুত থাকার এবং কোনপ্রকার শক্তি প্রয়োগ করলে তা সম্ভাব্য সকল উপায়ে প্রতিরোধ করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই।’