সাতসতেরো

ঢাকায় ইয়াহিয়া, ভবনে ভবনে কালো পতাকা

আন্দোলনে গত কয়েকদিনে হানাদারদের গুলিতে নিহতদের উদ্দেশে শোক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জন আকাঙ্ক্ষাকে তোয়াক্কা না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে ঢাকাসহ সারাদেশে উড়ছিল কালো পতাকা। 

১৯৭১-এর ১৫ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে চলছে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লাগাতার অসহযোগ আন্দোলন। সময় তখন অনিবার্য পরিণতির দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। 

গত ১৩ মার্চ জারি করা সামরিক আইন আদেশে সরকারি কর্মচারিদের আজ কাজে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হলেও কোন বিভাগের কোন কর্মচারী তাতে সাড়া দেননি। বরং তারা সামরিক আদেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেন এবং নাখালপাড়ায় এক প্রতিবাদ সভা করে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত কর্মসূচীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। 

সামরিক বিভাগের অধীনে অর্ডিন্যান্স ডিপোর প্রায় ১১ হাজার কর্মচারীর কেউই আজ কাজে যোগদান করেনি। 

বিকেলে বায়তুল মোকাররমে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় বলা হয়, “বাংলাদেশে কেবল বাংলার সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই কোন নির্দেশ জারি করতে পারেন এবং বাংলার জনসাধারণ কেবলমাত্র সেই বিধিই মেনে চলবে। কেননা বঙ্গবন্ধু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর নির্বাচিত নেতা।” 

তোপখানা রোডে বেগম সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের নারী সমাবেশ থেকেও বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত সকল কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়।  

এদিকে ঢাকা নগরীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভুয়া স্বেচ্ছাসেবকরা গোলযোগ তৈরির চেষ্টা করলে এদিন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আব্দুর রাজ্জাক বিবৃতিতে বলেন, “কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতকারী আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পোশাক ও টুপি নকল করে জনসাধারণের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। এসব দুষ্কৃতকারিকে ধরে আওয়ামী লীগ অফিসে প্রেরণ করতে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।” 

এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করতে বিকালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ঢাকা আসেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান নবনিযুক্ত সামরিক গভর্নর ‘বাংলার কসাই’খ্যাত লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান।

১৬ মার্চ শুরু হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-ইয়াহিয়া খানের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক। স্বাধীনতার দাবিতে অটল থেকেই বঙ্গবন্ধু পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় বসার ব্যাপারে সঙ্কল্পবদ্ধ। 

সমঝোতার নাটক করতে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে আসলেও মুক্তিকামী বাঙালী তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি অব্যাহত রাখে। দেশবাসীকে তাদের অধিকার বঞ্চিত করার প্রতিবাদস্বরূপ শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের খেতাব বর্জন অব্যাহত রাখেন। শিল্পাচার্য জয়নুলের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব বর্জন করেন। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ খেতাব বর্জনের বিষয়টি ব্যাপক সাড়া ফেলে। 

এদিন অধ্যাপক আবুল ফজলের সভাপতিত্বে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, সাংবাদিক নূর ইসলাম প্রমুখ। 

বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি টেলিভিশন নাট্যশিল্পী সংসদ এদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তাদের সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আবদুল মজিদ। বক্তব্য রাখেন সৈয়দ হাসান ইমাম, ফরিদ আলী, শওকত আকবর, আলতাফ হোসেন, রওশন জামিল, আলেয়া ফেরদৌস প্রমুখ।