ছেলেবেলায় প্রবাদ শুনেছিলাম: সকালের হাওয়া হাজার টাকার দাওয়া। তখন কথাটির মর্মার্থ ঠিক বুঝতে পারিনি। এখন এই বড়বেলায় ঢাকায় থেকে মর্মে মর্মে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারি- নির্মল বায়ু আমাদের জীবনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু একটি তুলনা দেই- আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন দুই থেকে তিন লিটার পানি পান করতে হয়, অন্যদিকে আমাদের ফুসফুসের জন্য প্রয়োজন দুই হাজার লিটার নির্মল বাতাস।
এবার সম্প্রতি প্রকাশিত একটি খবরে চোখ ফেরানো যাক। সংবাদ শিরোনাম: বিশ্বে ‘সবচেয়ে দূষিত’ বাংলাদেশের বাতাস। সেখানে বলা হয়েছে, বায়ুমানের তথ্য বিশ্লেষণ করে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২১ সালে বায়ু দূষণের মাত্রার বিচারে সবার উপরে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, প্রতিদিন বাতাসের সঙ্গে আমরা কি পরিমান দূষিত পদার্থ শরীরে গ্রহণ করছি। এখানে কি আমাদের কিছুই করার নেই? যখন আমরা জানি এই সত্য- ‘দূষিত বায়ু কমায় আয়ু’ তখন আমাদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে বৈকি।
খোলাসা করে বলি, যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, বায়ু দূষণের কারণে হওয়া ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। ২০১২ সালে এই রোগে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে যে পাঁচটি দেশে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের নাম রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরো বলেছে, ধূমপান, সড়ক দুর্ঘটনা এবং ডায়াবেটিস- এই তিন কারণে যে পরিমান মানুষ মারা যায় তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় বায়ু দূষণে। অথচ প্রতিনিয়ত আমাদের বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায় বায়ু এবং পানি দুটোই দূষিত হচ্ছে। এই দূষণ রোধ শুধু আইন করে সরকারের পক্ষে রোধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। আগে নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে। কারণ এই দেশ আমাদের, এই শহর আমাদের।
সাধারণ মানুষ দূষিত বাতাস বলতে কী বোঝে? বাতাসে যদি মাত্রাতিরিক্ত কার্বন মনো-অক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড, পার্টিকুলার ম্যাটার বা বস্তুকণা ও সালফার ডাই- অক্সাইড থাকে তবে তাকে আমরা বায়ু দূষণ বলি। এক সমীক্ষা বলছে, নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ধুলাবালির মধ্যে থাকা বস্তুকণা আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। পৃথিবীতে একই সূচকে বায়ু দূষণের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। একে বলা হয় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই)। এই সূচক অনুযায়ী ০-৫ ভালো, ৫১-১০০ মধ্যম, ১০১-১৫০ সতর্কাবস্থা, ১৫১-২০০ অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-৫০০ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি আরবান ল্যাবের হিসাব মতে প্রতি মাইক্রোগ্রাম বাতাসে ১-১২ মাইক্রোমিটার বস্তুকণা থাকার কথা। কিন্তু গত বছরের শুরুর দিকে ঢাকায় এটি ছিল যথাক্রমে ২২৫, ১৮৪, ২১৪, ২০২ এবং ২২৩ মাইক্রোমিটার। তাহলে বুঝতেই পারছেন আমরা কোন পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছি!
এবার আসুন বায়ু দূষণের কথা বলা যাক। দুটি উপায়ে সাধারণত বায়ু দূষণ হয়ে থাকে; প্রাকৃতিক উপায় এবং কৃত্রিম উপায়। প্রাকৃতিক উপায়ে সাধারণত আগ্নেয়গিরি, দাবানল, ধূলিঝড় ইত্যাদি আর কৃত্রিম উপায়ে হলো স্থির দহনের উৎস থেকে বায়ু দূষণ, চলমান যন্ত্রের দ্বারা, শিল্পকারখানা দ্বারা বায়ু দূষণ ইত্যাদি। এই দূষণের প্রভাব সরাসরি মানুষের উপর পড়লেও পরক্ষভাবে এই দূষণের হাত থেকেও আমরা রক্ষা পচ্ছি না। কারণ এর প্রভাব আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর, উদ্ভিদের উপর, প্রাণীকুলের উপর এবং বিভিন্ন পদার্থের উপর পড়ছে; যারা পরক্ষভাবে মানুষের জীবনের সঙ্গে কোন না কোনভাবে সংযুক্ত। প্রসঙ্গ ক্রমে এখানে উল্লেখ করতে চাই, আমাদের দেশের প্রখ্যাত নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ এবং বিএসএমএমইউ-এর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণগোপাল দত্ত বলেছেন বাংলাদেশে প্রায় ৭০ লাখ হাঁপানী রোগী রয়েছে যাদের অর্ধেকেরও বেশি শিশু। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার রোগীর অকাল মৃত্যু ঘটে এই ঢাকা শহরে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে বায়ু দূষণের প্রকোপ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। তখন হাঁচি, কাশি ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা এন্টিবায়োটিক, ইনহেলার ও বিভিন্ন পদের ওষুধে নির্ভর হয়ে পড়ে। তাদের এই সমস্যার জন্য দায়ী ঢাকার বাতাস।
শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য প্রতিটি বাবা-মা দিন নেই, রাত নেই অর্থ উপার্জনের পেছনে ছুটছেন। কারণ তারা চান সন্তান যেন ভবিষ্যতে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল থাকে। কিন্তু আমরা নির্মল পরিবেশের কথা ভাবছি না। অথচ সন্তানদের ভবিষ্যতে সুস্থ থাকার জন্য সুস্থ পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। আমরা সন্তানের মঙ্গলের জন্য অনেক টাকা ব্যাংকে কিংবা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রেখে গেলাম কিন্তু এমন একটা দূষিত পরিবেশে রেখে গেলাম, সেখানে তারা ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছে না। বলুন তো তারা ভালো থাকবে কিভাবে? এজন্য উচিত প্রচুর গাছ রোপণ করা। সন্তানের জন্য হলেও ঘরের কোণায় বা বারান্দায় টবে গাছ লাগানো উচিত। বাড়ির ছাদে বাগান করা এখন আপনার দায়িত্ব। আমি প্রতিটি বাড়ির মালিককে বিনীত অনুরোধ করবো- আপনারা এই কাজটি করুন এবং প্রতিটি ভাড়াটিয়াকে বলবেন, বারান্দায় যেন তারা গাছ লাগায়। বাড়িতে ভাড়াটিয়া উঠানোর সময় আপনার প্রথম শর্ত থাকবে এটি। আজকে ঢাকা শহরের প্রতিটি বাড়ি যদি বৃক্ষবাড়ি হয়, তাহলে শহরের মোট অক্সিজেনের পরিমান দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। আসুন আমরা সন্তান স্বজনদের নিয়ে ভালো থাকার জন্য বৃক্ষপ্রেমী হই।
বায়ু দূষণ রোধে ঢাকা সিটি থেকে দূর করতে হবে ধুলোবালি। এ জন্য কলকারখানাগুলো ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে হবে এবং উদ্যোগ নিতে হবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে যত কম পরিমান ক্ষতি করে দূষিত ধোঁয়া রোধ করা যায়। বর্তমান সরকার ট্যানারী শিল্প ঢাকার হাজারীবাগ থেকে নিয়ে সাভারে স্থানান্তরিত করেছে। এ জন্য সঠিক বৈজ্ঞানিক উপায়ে এটিপি স্থাপন করেছে যাতে বর্জ্য দূষিত পানি পরিবেশে গিয়ে দূষণ না ঘটাতে পারে। দেরী হলেও এই উদ্যোগটি অব্যশই প্রশংসনীয়। এভাবে আরো উদ্যোগ নিতে হবে।
অন্যদিকে বর্জ্য পদার্থগুলো এমন জায়গায় ফেলতে হবে যেন সেটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্বানস্থ্য ঝুঁকির কারণ না হয়। আমি মনে করি, ভালো কাজের জন্য স্বদিচ্ছাই যথেষ্ট। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠুক নির্মল স্বাস্থ্যকর পরিবেশে; দূষিত বায়ু নয় বরং নির্মল বায়ু হোক আমাদের পরমায়ু বৃদ্ধির মূল কারণ। আমরা আর সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের বাসিন্দা হতে চাই না।
লেখক: বিজ্ঞান গবেষক ও লেখক