গাইবান্ধায় ধান ভানার বিদ্যুৎচালিত ঢেঁকি তৈরি করে এলাকায় সাড়া ফেলেছেন বিজ্ঞানী শফিকুল ইসলাম শফিক। পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ স্বয়ংক্রিয় ঢেঁকিছাঁটা লাল চাল এলাকার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশে। প্রাথমিকভাবে দুটি ঢেঁকি দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও শিগগিরই এই প্রযুক্তির প্রসার ঘটাতে চান শফিকুল।
গাইবান্ধা শহর থেকে উত্তর-পূর্বে ৪ কিলোমিটার দূরে খামার বোয়ালী গ্রাম। ওই গ্রামের বাসিন্দা প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম শফিক। বাবা আফসার উদ্দিন কাপড়ের ব্যবসা করতেন বোয়ালী বাজারে। পিতার জমিজমা আর দোকানের আয় দিয়ে ৭ জনের সংসার ভালোই চলে যাচ্ছিল। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে শফিকুল ৪র্থ। বাবার আশা পূরণ করতেই তিনি এসএসসি পাস করে তিনি বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা পাস করেন। তারপর উ্চ্চতর ডিগ্রি নিতে তিনি ভর্তি হন অতিশ দীপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে তিনি বিএসসি পাস করেন।
১৯১৬ সালে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। বার্ধক্য জনিত কারণে বাবা আফসার উদ্দিনের মৃত্যুর পর সংসারে সমস্যা দেখা দেয়। ছোট বোন ছাড়া সব ভাইবোনের বিয়ে হয়ে যায়।
এলাকার বাসিন্দা নওসের আলম জানান, তাদের পরিবারের সাথে তার ভালো সম্পর্ক। তাই তাদের সম্পর্কে অনেক কথাই জানেন। তিনি বলেন, ইঞ্জিনিয়ার সফিক বিয়ে করেন সুরাইয়া জান্নাত হিমিকে। মা অরুনা বেগম ও বোন আখি এবং বউকে সাথে নিয়ে তার সংসার। বাড়ির সবাই চান ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ভালো চাকরি করবেন সফিক। কিন্তু তার মাথায় চাকরির চিন্তা ছিল না তার। তিনি সবসময় চিন্তা করতেন পরাধীন চাকরির চেয়ে বাড়িতে গিয়ে কিছু একটা করবেন। কিন্তু মা, স্ত্রী ও ভাইবোনদের চাপের মুখে তিনি ঢাকায় একটি বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করেন।
মা অরুনা বেগম বলেন, চার বছর চাকরির পর ছেড়ে চলে আসে গ্রামে। তারপর ভাবতে থাকে কিছু একটা করতে। বাপ দাদার আমলের পা চালিত কাঠের ঢেঁকি হারিয়ে যেতে বসেছে। তা ছাড়া পা চালিত ঢেঁকিতে পরিশ্রম বেশি এবং খুব বেশি ধান ভানাও যায় না। এই চিন্তা মাথায় নিয়ে সে পা চালিত ঢেঁকি তৈরির কাজ শুরু করে। ঢেঁকি ছাটা চাল আর পাওয়া যায় না কিন্তু চাহিদার কমতি নেই। বিদ্যুৎচালিত ঢেঁকি তৈরি করতে পারলে একদিকে যেমন ‘ঢেঁকছাড়া’ লাল চাল পাওয়া যাবে, তেমনি কমে আসবে শ্রমিকের কাজ।
শফিকুল ইসলাম শফিক বলেন, বাজারে চালে লাল রঙ মিশিয়ে ঢেঁকি ছাটা হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। মানুষের প্রধান খাবার চালকে ভেজাল মুক্ত করতে এবং সহজে ঢেঁকি ছাটা লাল চাল তৈরির জন্য ২০২০ সাল থেকে গবেষণা শুরু করি। সনাতন পদ্ধতিতে ঢেঁকিতে লাল চাল তৈরি করতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। সহজে এবং কম সময়ে যাতে বেশি চাল ভানা যায় এ কারণে আমার গবেষণার কাজ চলতে থাকে।
শেষে ৭ মাসের পরিশ্রমে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে তৈরি করতে সক্ষম হন তিনি। তারপর বাড়ির উঠোনে বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে ঢেঁকি বসিয়ে দেন। এই মেশিনে প্রতিদিন গড়ে ৭ থেকে ৮ মণ ধান ভানা যায়। তার এই কারখানায় সার্বক্ষণিক দুজন নারী শ্রমিক কাজ করছেন। এই চাল দেখতে লাল ও পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। এই চালের চাহিদা থাকায় দামও একটু বেশি।
এই চাল কিছু দিন বাজারে বিক্রির পর চাহিদা বেড়ে যায়। দাম বেশি হলেও মানুষ ঢেঁকিছাঁটা লাল চাল কিনতে আগ্রহী। শফিকের বিদ্যুৎচালিত ঢেঁকি তৈরি ও লাল চাল উৎপাদনের কথা জেলা ছাড়িয়ে অন্য জেলার ব্যবসায়ী ও কাস্টমারদের কাছে।
খামার বোয়ালী হিন্দুপাড়ার মানিক সাহা বলেন, চাল দেখেছি খুব লোভ হয়েছে। দাম কম হলে আমরা হয়তো সুযোগ নিতে পারতাম। তবে ভালো লাগে আমাদের গ্রামের একজন মানুষ বিদ্যুৎচালিত ঢেঁকি তৈরি করেছেন।
শফিক বলেন, ঢাকা, চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন ঢেঁকিছাঁটা লাল চাল পাইকারী কিনতে। চাহিদা ভালো, দামও ভালো পাওয়ায় লাভের পরিমাণ বেশ ভালো আসে হাতে। কয়েক দিনে লাল চাল বিক্রি করে লাভ যা হয়েছে, তার পরিমাণ কম নয়। আমাকে আর চাকরি করতে হবে না। কিন্তু পুঁজির পরিমাণ বেশি হলে আরও ভালো আয় করা সম্ভব। আর্থিক সহযোগিতা পেলে পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এই লাল চাল জেলায় জেলায় ছড়িয়ে দিতে পারবো।
নারী শ্রমিক বুলু রানী বলেন, আগে ঢেঁকিতে ধান ভানার কাজ করেছি। খুব পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু এখন আর সেরকম কষ্ট হয় না। সাবেদা বুবুকে সাথে নিয়ে দুজনে ৮ মণ চাল ঝাড়ার কাজ করি।
বোয়ালী ইউপি চেয়াম্যান শহিদুল ইসলাম সাবু বলেন, শফিকুল আমাদের গ্রামের গর্ব। তিনি ঢেঁকি তৈরি করে সুনাম কুড়িয়েছেন। তার উৎপাদিত ঢেঁকিছাঁটা লাল চাল আবার আমরা খেতে পারবো, সত্যিই আশ্চর্য লাগে । তার সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে যাক, এই কামনা করি।