ক্যাম্পাস

সাইকেলে ৪৪ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ফুলের রাজ্যে 

ইয়াসিন, ইহসান, রাকিব, নাদিম, তালহা, আবরার ও আমি। বয়স-ক্লাসে সামান্য পার্থক্য থাকলেও আমাদের কেউ তা বুঝে উঠতে পারি না। এ ছাড়া, রাফিদ, শাওন, মেহেদি, আদনান আর শাহিনও। একদিন প্ল্যান হলো সবাই যাবো সাইকেল চালিয়ে বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী বলে খ্যাত যশোরের গদখালীতে।

দিনটি ছিল ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২। পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ইয়াসিন, ইহসান, রাকিব, নাদিম, তালহা, আবরার আমরা সাতজন বেরিয়ে পড়লাম সাইকেল নিয়ে। সাতজন যাচ্ছি কারণ বাকিরা বিভিন্ন কারণে বেরুতে পারবে না। প্ল্যান মোতাবেক আমাদের যাত্রা শুরুর স্থান যশোরের আরবপুর। অতঃপর সেখান থেকে ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ইউনিয়নে। যার দূরত্ব যাওয়া আসা মিলে ৪৪ কিঃমিঃ। আমাদের সবার জন্যই প্রথম এত দূরত্বের সাইকেল যাত্রা। প্ল্যান হলো সবাই সকাল সাড়ে ৭টায় একসাথে হবো যশোরের চাঁচড়া মোড়ে। তারপর, একসাথে যাত্রা করবো গদখালীর উদ্দেশ্যে। সময়মতো সবাই আসলেও একটু দেরি হলো আমার, ইয়াসিন আর নাদিমের।

অবশেষে চাঁচড়া থেকে সকাল ৮টায় যাত্রা শুরু করলাম। রাস্তার কিনারা দিয়ে সাতজন সাতটা সাইকেল চালিয়ে চলেছি ঝিকরগাছা উপজেলার দিকে।বেনাপোল রোড দিয়ে ঝিকরগাছায় যেতে হয়। তাই যশোর রোডের বিশাল বড় বড় ঐতিহাসিক গাছগুলোর নিচ দিয়েই সাইকেল চালিয়ে পার হলাম আমরা। রাস্তায় কিছুক্ষণ পরপর নেমে চলছিল ভিডিও আর ফটো শুট। আর গল্পে গল্পে সাইকেল চালাতে চালাতে পৌঁছে গেলাম ঝিকরগাছা ফুল বাজারে।

তখন বাজে সকাল ৯.২৫ মিনিট। চারদিকে লোকজনে ভরপুর। বিভিন্ন রঙয়ের গোলাপ, গাঁদা, হাসনাহেনা, চন্দ্রমল্লিকা, ডেইজি, জারবেরা, জিপসি, গ্লাডিওলাসসহ বাহারি রঙের নানা জাতের ফুল বেচা-কেনা দেখে হতবাক আমরা। আগে এত পরিমাণে ফুল এক স্থানে আমি দেখিনি। ফুলের দামও অনেক সস্তা। পকেটে বেশি টাকা নাই বলে ফুল কেনার লোভ সামলাতে বাধ্য হলাম।

হঠাৎ, খেয়াল করলাম সবাই সাইকেল নিয়ে গদখালী রাস্তার মোড়ে আমার জন্য দাঁড়িয়ে। তাড়াতাড়ি দলে ফিরে ফাঁকা রাস্তায় একটানে গদখালীতে। কদমতলা, নিমতলা, পরিত্যক্ত রেললাইন আরও অনেক গ্রাম মিলে চাষ হয় নানা জাতের ফুল। গদখালী বাজারের পাশে ছিল একটা বিশাল লেক। যেহেতু সেদিন ছিল শুক্রবার আর আমরাও ছিলাম ক্লান্ত তাই রাকিব, আবরার আর আমি লেকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বাকিরা ঠান্ডায় পানিতে নামতে সাহস পেলো না।

মাঘ মাসের প্রচন্ড ঠান্ডায় শরীরের হাড় পর্যন্ত জমে যাওয়ার অবস্থা প্রায়। তবে, বেশ কিছু সময় বরফের মতো পানি ঝাঁপাঝাপি করে হালকা রোদে শরীর শুকিয়ে ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। আবার বের হলাম ফুল দেখতে। ধবধবে সাদা রজনীগন্ধা ও চন্দ্রমল্লিকা, লাল, খয়েরি, হলুদ আর মিশ্র রঙের গ্লাডিওলাস, ডেইজি, জেসিকা আর জারবেরা ফুলের সেড বিশাল ফুলের সমারোহ, বিশাল বিশাল সূর্যমুখী আর গোলাপ বাগানের সৌন্দর্যে মনে হলো যেন নেদারল্যান্ডে চলে এসেছি। আচমকা খেয়াল হলো এ বছরে গদখালীতো চাষ হওয়া টিউলিপ ফুলের কথা, যেটা রয়েছে আমাদের পাশের এক বাগানে।

একটু পরেই সাইকেল নিয়ে আমরা চললাম সেই বাগানে।যেয়ে দেখি এলাহী কান্ড! গোলাপী, সাদা আর লাল-হলুদ রঙয়ের শত শত টিউলিপ ফুটে আছে বাগানে। দূর থেকে মানুষ এসেছে টিউলিপ দেখতে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলও এসেছে ভিডিও স্যুট করতে। ফুল দেখতে সেডের একেবারে কাছে চলে আসলাম। কিন্তু এটা কি! বাগানের ভেতরে যেতে লাগবে জনপ্রতি ৫০ টাকা করে প্রবেশ ফি।যেটা দেখে বাকি বন্ধুরা আর ভেতরে ঢুকলো না। একটু বেশিই ফুলপ্রেমী রাকিব আর আমি বাগানের ভেতরে না ঢুকে পারলাম না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় দিয়ে অনেক ইনিয়ে-বিনিয়ে একশত টাকার পরিবর্তে সত্তর টাকা দিয়ে দুজনে প্রবেশ করলাম। ভেতরে ঢুকে প্রচুর ছবি তুললাম আর ভিডিও করলাম। এদিকে জুম্মার নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছিল বলে তাড়াতাড়ি বাগান থেকে বের হয়ে পাশের এক মসজিদে সবাই একসাথে নামাজ আদায় করলাম। তারপর আরেকটু এদিক সেদিক ঘুরলাম।

এ দিকে পেটে ইঁদুর দৌঁড়ানো শুরু হয়েছে। সাইকেল নিয়ে সবাই একটানে ঝিকরগাছা বাজারে এক হোটেলে খেতে বসলাম। তালহা ও আবরার মুরগি আর আমরা গরুর মাংস দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। রান্নাটা বেশ মজাদার হওয়াতে সবাই উদরপূর্তি করে খেলাম। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম।

হালকা রোদে বেনাপোল রোডের বিশাল বিশাল গাছের ছায়া দিয়ে দলবেধে সাইকেল চালানোয় কোনো ক্লান্তিবোধ হলো না। রাস্তার কিনারা দিয়ে কোন সময় সাইকেল চালিয়ে ২২ কি.মি. পেরিয়ে আসলাম বুঝতে পারলাম না। যাইহোক প্রায় দেড় ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে অবশেষে যাত্রা শেষ করলাম। দিন শেষে ফুলময় একটা সুন্দর স্মৃতি নিয়ে সবাই নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে এলাম।