মতামত

ঈদ: সেকালে একালে 

নিজের স্মৃতিশক্তির উপর আস্থা থাকলেও বিষয়টা আরো ঝালিয়ে নিতে ছোট বোনকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, ছোটবেলায় আমরা কেমন করে ঈদ করতাম, বোন তোর মনে আছে?’

আমরা পিঠাপিঠি দুই বোন, এক বছরের ছোট-বড়। একসঙ্গে মানুষ হয়েছি সত্তর-আশির দশকের শান্ত নিরিবিলি ঢাকার মহাখালিতে। বনভবনের সাদা দালানের পেছনে একটা ছায়া-ছায়া গলির ভেতর ছিল আমাদের টিনশেড ভাড়া বাসা। সেই বাসায় ঈদ আসার আগে আম্মা আমাদের নিয়ে উঠান থেকে মাথা উঁচু করে দূরের আকাশে এক ফালি চাঁদ খুঁজতেন। ঘরে তখনো টেলিভিশন আসেনি, আমরা রেডিও ছেড়ে বসে থাকতাম, চাঁদ উঠলেই বাদ্য বাজনা সহযোগে- ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’- গানটা শুনবার জন্য।  

সেই রাতেই আম্মা ঈদের দিনের কোরমা রান্না করার জন্য মশলা ভেজাতেন, পেঁয়াজ রসুন কাটার তোড়জোড় চলতো। তার আগে মাসজুড়ে ছিল নতুন জামা-জুতা কেনার পর্ব। রেডিমেড নয়, কাপড় কিনে ঘরে সেলাই করা জামা পরার চল ছিল তখন। বোন মনে করিয়ে দিলো, আব্বা-আম্মা নিউমার্কেটে গিয়ে তাদের দুই মেয়ের জন্য একই রকম গজ কাপড় কিনে আনতেন। আম্মা সেই ছিট কাপড় কেটে সেলাই মেশিনের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ফ্রক সেলাই করতেন। আমরা খুব সতর্ক থাকতাম যাতে সেই কাপড় ঈদের সকালের আগেই কেউ দেখে না ফেলে। দুই বোন মিলে কাটা কাপড়ের টুকরোগুলো পর্যন্ত লুকিয়ে রাখতাম, পাছে পাশের বাসার খেলার সাথীদের কারো চোখে পড়ে যায়! 

এখন ভাবি, যদি ওরা আগেই দেখতো, তাহলে এমন কি হতো? আসলে, তখন এমন একটা ধারণা ছিল আমাদের- নতুন জামা আগেই বন্ধুদের দেখিয়ে ফেললে সেটা নাকি পুরনো হয়ে যায়। বড়দের কাছ থেকেই হয়তো শিখেছিলাম সেটা। 

ঈদের দিন ভোরবেলা আম্মা ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন, পাঠিয়ে দিতেন গোসলখানায়। ঈদ উপলক্ষে নতুন সুগন্ধী সাবানের মোড়ক খোলা হতো। স্নানঘর ভরে যেত সুগন্ধে। নতুন সাবান দিয়ে ঈদের সকালে গোসল করার এই রেওয়াজ এখনো আমার আম্মার বাসায় আছে। আমরা গোসলখানা থেকে বেরিয়ে নতুন কাপড় পরতাম। সাজগোজ করতাম। ততক্ষণে সকালের নাস্তার জন্য আম্মা টেবিলে কয়েক রকমের সেমাই রান্না করে সাজিয়ে রেখেছেন। দুধ সেমাই, নারকেল দিয়ে রান্না করা জর্দা সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, বগুড়ার চিকন সেমাই, চালের গুঁড়ো দিয়ে হাতে বানানো সেমাই..। রকমারি সেমাই খেয়ে, নতুন পাঞ্জাবি পায়জামা পরে, আতরমাখা তুলো কানে গুজে আব্বা ছোট ভাইদের নিয়ে ছুটতেন ঈদের নামাজ পড়তে। 

আমরা কাজল, লিপষ্টিক, ক্লিপ, ফিতা নিয়ে আনাড়ি হাতে সাজতে বসতাম। আম্মা তখন হয়তো রান্নাঘরে ব্যস্ত দুপুরে খাওয়ার জন্য পোলাও, মাংস রান্না করতে। আব্বা নামাজ পড়ে ফিরলে শুরু হতো সালাম পর্ব। সালামের সঙ্গে সেলামিরও একটা সম্পর্ক থাকে। এক টাকা, দুই টাকা, পাঁচ টাকা সেলামির হার। এর মধ্যে একবার প্রতিবেশী খালু, যিনি ছিলেন সৌদি প্রবাসি, ছুটিতে দেশে এসেছেন, শুনতে পেলাম পাড়ার ছোটরা যারাই তাকে পা ছুঁয়ে সালাম করছে তাদের তিনি ১০ টাকা করে সেলামি দিচ্ছেন। খবরটা প্রথম নিয়ে এলো আমাদের ছোট ভাই, পকেট থেকে লাল চকচকে ১০ টাকার নোট বের করে আমাদের নাকের সামনে মেলে ধরে ও বললো, ‘লাগবে? তাহলে দৌড়াও।’

আমরা পড়িমরি করে দিলাম ছুট। এ সুযোগ কিছুতেই হেলায় হারানো যাবে না। কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ। গিয়ে দেখি খালু বাসায় নেই। খালাম্মা এক রকমের মিষ্টি রান্না করতেন, সেটা হলো ঘন দুধ আর চিনিতে জ্বাল দেওয়া বাকরখানি। প্লেট ভরে আমাদের সেই দুধে ভেজানো নরম বাকরখানি খেতে দেওয়া হলো। ধীরে ধীরে খাচ্ছি আর অপেক্ষা করছি খালুর জন্য। কিন্তু খাবার ফুরিয়ে যায়, খালু আসেন না। বিফল মনোরথে যখন ফিরে আসার জন্য উঠে পড়েছি (কারণ আর বসে থাকাটা শোভনীয় দেখাচ্ছে না) তখন দরজার মুখে খালুর সাথে দেখা। আর যায় কোথায়- দুই বোন ঝাপিয়ে পড়লাম তার পায়ের উপর। এবং কামিয়াব হলাম। চকচকে ১০ টাকার নোটে পকেট গরম করে ঘরে ফিরলাম।

এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে আমাদের সমবয়সীরা আসতো। সারাদিন তাদের সঙ্গে সেজেগুজে টো টো করে পাড়া বেড়াতাম, দোকান থেকে গোলাপি রঙের কাঠি লজেন্স, মুড়ালি বা বাবুল বিস্কুট কিনতাম। বেলুন লাগানো বাঁশি কিনতাম- পোঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ শব্দ করে সেসব বাজতো! 

ঈদের দিন মানে ছোট্টবেলার অবাধ স্বাধীনতা, পড়ালেখার তাড়া নেই, বাধাধরা নিয়মের বালাই নেই, মা-বাবার বকা-ঝকা নেই, ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াও যেখানে ইচ্ছা সেখানে। বাসার ভালো রান্না পেটপুরে খাও। সন্ধ্যা থেকে টেলিভিশনের সামনে বসে অনুষ্ঠান দেখো, দেখো আনন্দ মেলা, দেখো বাংলা সিনেমা। সব দেখেটেখে দাও নিশ্চিন্ত ঘুম। মাঝে মাঝে ঈদে যেতাম নানার বাড়ি নেত্রকোনা। মামা খালা নানা নানীর আদরে স্নেহে প্রশ্রয়ে মহাআনন্দে কাটতো ঈদের দিন। একবার প্রথম বারের মতো মা-বাবাকে ছাড়া খালাদের সঙ্গে ঈদ করতে চলে গেছি নেত্রকোনা। বিকেলের দিকে ছোট মামা একজন রিকশাওয়ালাকে ডেকে এনে তার হাতে টাকা গুজে দিয়ে বললেন, ‘তুমি বসে থাকো। আজকে আমি আমার ভাগ্নিদের নিয়ে রিকশা চালাব।’ যেই কথা সেই কাজ। আমাদের দুই বোনকে রিকশায় চড়িয়ে মামা নিজেই রিকশাওয়ালা হয়ে গেলেন। গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করলেন, ‘আমি রিকশাওয়ালা বেচারা…। তারপর তেরিবাজার, বড়বাজার ঘুরিয়ে আবার ছোটবাজারে ফিরে এলেন। ভারি মজা হয়েছিল সেই ঈদের বিকালে। 

রমজান মাসে সাতাশ রোজার রাতে হাতে মেহেদি পরার চল ছিল। এখনকার মতো টিউবের মেহেদি ছিল না তখন, গাছের পাতা শিল পাটায় বেটে পেস্ট করে নখসহ আঙুলের মাথায় গোল করে মেহেদি লাগানো হতো, হাতের তালুতে আঁকা হতো চাঁদ তারা, ফুল লতাপাতা। 

আমাদের ছোটবেলায় পাড়ায় পাড়ায় লেইস ফিতাওয়ালারা আসতেন তাদের রহস্যময় বাক্স নিয়ে। ঈদের আগে তাদের কদর বেড়ে যেত খুব। গলির ভেতর ঢুকেই বিশিষ্ট কায়দায় তারা উচ্চ কণ্ঠে হাঁক ছাড়তেন, ‘লেইস ফিতাআআআ।’ তাদের হাতে থাকতো একটা কাঁচের বাক্স, যেখানে বাইরে থেকে দেখা যেত থরে থরে কানের দুল, গলার চেইন, মাথার ক্লিপ, লিপষ্টিক, রুজ পাউডার ইত্যাদি নানান কিছু সাজানো রয়েছে। লেইসফিতাওয়ালার পিঠে কাপড় দিয়ে পুটুলির মতো বাঁধা থাকত হরেক রকম জিনিসে ঠাসা আরো তিনটা কাগজের বাক্স। সেগুলিতে থাকতো চুলের ফিতা, চিরুণী, পাউডারের কৌটা, কাজল, নেইলপলিশ, আলতা, চুড়ি, টিপের পাতা আরো কতো কি!  গলির মুখে লেইসফিতার হাঁক শুনলেই আম্মাকে গিয়ে ধরতাম- ‘আম্মা, লেইসফিতাওয়ালাকে ডাক দেই? ও আম্মা ডাকবো? আম্মা ডাকি? চলে যাচ্ছে তো!’ আম্মা ‘হ্যাঁ’ বললে তো কথাই নেই। আর ‘না’ বললে ঘ্যান ঘ্যান চলতেই থাকতো। 

এখন আর সেই লেইসফিতাওয়ালাদের দেখা মেলে না। শৈশবের লেইসফিতাওয়ালার মতোই আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকে ঈদ আনন্দের তীব্রতা। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ম্লান হতে থাকে ঈদের উত্তেজনা। তবু ঈদ আসে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, নিত্য নতুন আনন্দে।