রেড ওয়াইন তৈরি হয় কালো আঙুরের রস থেকে। অপূর্ব! তুমি খেয়েছ বিরামদা ? হুঁ। বিরাম সাহা ক্যামেরা তাক করতে করতে বলল।
লেন্সের কেন্দ্রে মুক্তামালার মুখ। রাজকন্যার মুখখানিতে এমন এক মায়া আছে, হাসি আছে, বিরাম ফোটোওয়ালা তা বেচতে পারে নানা কোম্পানিতে। বিজ্ঞাপন। সব চুক্তিই মুক্তার সঙ্গে হয়, কিন্তু ছবি এই ফোটোওয়ালার। একটা নতুন দেশি ওয়াইন নামছে বাজারে। তার বিজ্ঞাপন শুরু করবে কোম্পানি। করছে এক বিখ্যাত পরিচালক। নতুন ছবি আরম্ভের আগে এই কাজটি করতে চায়। বিজ্ঞাপন চিত্র করেন তিনি, শর্ট ফিল্ম, ডকুমেন্টারি আর ফিচার ফিল্ম... সবই করেন। এক সূত্রে বিরাম সাহার কাছে কয়েকটা মুখ চেয়েছেন তিনি।
মুক্তা দীর্ঘাঙ্গী। পাঁচ ফুট চারের উপরে। অ্যাভ্যারেজ বাঙালি কন্যাদের চেয়ে বেশি। কিন্তু গায়ে মেদ জমছে। গড়নই অমন। কিছু করার নেই। ও জানে জিম করে ফিট রাখতে হবে নিজেকে। ফিট থাকলেই হলো। আর সামান্য মেদ কমলে মুক্তা পারবে। এখনো পারবে কয়েক বছর। কম বয়সেই চোখে চশমা উঠেছে। চশমায় বয়স বেড়ে যায়, মুক্তারও বেড়েছে। অবশ্য চশমা তো ছবিতে থাকে না। অপূর্ব চোখ। চোখেই সে জয় করে নেয়। কোন দৃষ্টির কোন মেসেজ তা মুক্তা জানে। বিরামকে শেখাতে হয় না কিসে বিস্ময়, কিসে মুগ্ধতা, কোন দৃষ্টিতে প্রেমের উদ্ভাস, কোন দৃষ্টি নির্মোহ। মুক্তা জানে। অভিনেত্রী হতে চায়। কিন্তু সুযোগ করে নিতে পারছে না। বিরাম জানে পারবে। সময় একদিন আসবে। মুক্তা বলে, হচ্ছে না গো ফোটোওয়ালা, হচ্ছে না, কেন যে হচ্ছে না, বলতে পারব না।
অনেকদিন বাদে এসেছে মুক্তা। বিরাম ডেকেছিল। ভালো পরিচালক। লেগে গেলে মুক্তার দাম বাড়বে। বিজ্ঞাপনের নারী থিয়েটারেও সুযোগ পাবে। সিনেমা, সিরিয়ালেও। মুক্তার লক্ষ্যই মেগা সিরিয়াল। সিনেমা। মেগা সিরিয়ালে লোকে চেনে বেশি। একটি দুটিতে অপ্রধান চরিত্র করেছে। সে চায় প্রধান চরিত্র। ঘুরছে, খুব ঘুরছে। স্টুডিও পাড়ায় ঘোরার শেষ নেই। বসে বসে ফিরে আসে। অডিশন নেয়, ছোট চরিত্রে সুযোগ হয়। বিরাম একদিন বলেছিল, সেদিন একটা খবর দেখলাম, মেগা সিরিয়ালের। কী খবর ফোটোওয়ালা? এক পরিচালক কী বলেছে নতুন অ্যাকট্রেসকে। ওয়ান নাইট বেড শেয়ার? হুঁ। বিরাম ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। থাক ক্যামেরা। অনেকদিন বাদে এলো, গল্প করবে আজ। আজ তো ফোটোশ্যুট হবে না।
রোল না পেলে অনেকে এমন বলে ফোটোওয়ালা। সত্যি না? সত্যি কি, সত্যি না- কে বলবে বলো? তোমার কী মনে হয়? কিছুই মনে হয় না বিরামদা, মনে করে লাভ কী, আমাকে কাজ পেতে হবে, মডেলিঙ তো বড়জোর ২৮-৩০ অবধি, এখন হাই টাইম, যেভাবে হোক আমাকে আমার কেরিয়ার করতে হবে, জানি না কীভাবে।
এখন তার সামনে বসে আছে ২৫ প্লাস। মনে হয় ২০-২১। মুক্তার মুখের ভিতরে বিরাম সাহা কোনো এক অভিনেত্রীর ছায়া দেখতে পায়। রাজশ্রী। কয়েকটি ছবি করে আমেরিকা চলে গিয়েছিল। আর ফেরেনি সিনেমায়। ব্রহ্মচারী। শাম্মি কাপুর ও রাজশ্রী। সেই যে অনাথ শিশুদের সঙ্গী ব্রহ্মচারী শাম্মি কাপুর নিয়ে এলো ক্ষুধার্ত রাজশ্রীকে। আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল সে সমুদ্রে। সেই রকম, ঠিক সেই রকম। যেমন কোমল, পবিত্র তেমন আকর্ষণীয়, বিষাদময়ী, যৌন আবেদনে ভরা সেই রাজশ্রী। অসম্ভব ভালো নাচতে পারত। পাগল শাম্মি কাপুরের সঙ্গে পাগলিনী হয়ে অভিনয় করেছিল। একটা গান ছিল চাক্কা মে চাক্কা, চাক্কে সে গাড়ি, গাড়ি সে নিকলি, আপনে সওয়ারি...। অনাথ শিশুরা আর সেই দুজনের কথা মনে পড়ে তনিমাকে দেখলে। সত্যিই কি মুক্তা রাজশ্রীর মতো? ঠিক মনে নেই। ইউটিউবে দেখে সে বলেছিল একদম না। একদম না। না কেন? আমি ঐ রকমই না। তা হবে কেন, তুমি তোমার মতো। মুক্তামালা বলেছিল, ফোটো-আঙ্কেল আমার পছন্দ মহুয়া রায়চৌধুরী।
আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল। তা কি জানে মুক্তা? তার জন্মের আগের ঘটনা। মহুয়া কেন রাজশ্রীও তো অনেক আগের। অনেক অনেক। এখন সে বেঁচে আছে না নেই, তা জানে না বিরাম সাহা। শাম্মি কাপুর নেই। কাপুর পরিবারের সেই প্রজন্মের কেউ নেই, রাজ কাপুর, শশী কাপুর, শাম্মি কাপুর। এঁদের বাবা ছিলেন পৃথ্বিরাজ কাপুর। কাপুর পরিবার শাখায় প্রশাখা অনেক। প্রায় সকলেই সিনেমায় জড়িয়ে আছে। পুত্র, পুত্রবধূ...। মহুয়া রায়চৌধুরীর সিনেমা দেখেছে তনিমা ইউটিউবে। মহুয়ার কথা বললে বিরাম সাহার মনে পড়ল রত্না ঘোষালের কথা। একেবারে আটপৌরে মেয়ে। পাশের ফ্ল্যাটের মেয়ে। রত্না ঘোষালের নাম কি মুক্তা শুনেছে? মুক্তা হেসে বলল, না গো ফোটোওয়ালা।
ফোটোওয়ালা বলল, সে রত্না ঘোষালের স্টিল ফোটো তুলেছিল একবার। ছবির নামটি ভুলে গেছে। রত্না ঘোষালের কথা সেদিন আচমকা মনে পড়তে ইউটিউবে খুঁজেছিল। এখন তিনি প্রায় বৃদ্ধা। উত্তমকুমারের সঙ্গে অভিনয়ের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে ধরেছিলেন। সুপ্রিয়া চৌধুরীর কথা বলছিলেন। সেই আটপৌরে ভাবটি আছে বটে, কিন্তু এও বেশি মনে হয়েছিল বড় বেশি আটপৌরে। সে তো সকলেই তা হয়ে যান বয়সকালে। মুক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে বিরাম সাহার মনে এলো প্রবীণা অভিনেত্রীর কথা। আজ থেকে তিরিশ, চল্লিশ বছর বাদে মুক্তার চেহারাটি বিরাম যেন দেখতে পায়। ভারি শরীর, ভারি মুখ, গোলগাল এক ঘরোয়া মহিলা। মহুয়ার তা হয়নি। মহুয়া মরে গেছে তার রূপ নিয়েই। মুক্তা ভেবেছে ঐ চিরকালের রূপ নিয়েই জীবন কাটাবে। মধুবালা মারা গিয়েছিল রূপ নিয়ে। মুক্তার পছন্দ মধুবালাও। একদিন বলেছিল মধুবালার কথা। আজ বলছে মহুয়ার কথা।
মুক্তামালা শ্বাস নিতে নিতে ক্লান্তির স্বরজড়িয়ে বলল, ফোটোওয়ালা আমি কি পারব? কী পারবি? মহুয়া বা মধুবালার মতো? মুক্তামালা পা ছড়িয়ে দিয়েছে কারপেটের উপর। নীল রঙের কুর্তি ও ঢোলা পায়জামা, একই রঙের। কানে নীল বিন্দু। নাকে নীল নথ। কপালে নীল টিপ। নীল রিবনে চুলের গোছ বাঁধা। সব রঙ মিলিয়ে পরা। মুক্তামালার দিকে তাকিয়ে ছিল বিরাম। মুক্তামালা হেসে জিজ্ঞেস করে, কী দেখছ গো ফোটোওয়ালা? বিরাম বলল, দেখছি কোন অ্যাঙ্গেলে কেমন তুই। ইসস! দ্যাখোনি যেন, তোমার চোখ কি ক্যামেরা? তাইই। মুক্তা বলল, না, তোমার চোখে পুরুষ মানুষ।
খুব সাহস এই মেয়ের। একদিন ফোটোশ্যুট হলো একটু খোলামেলা, জিন্সের শটস আর শ্লিভ্লেস টি শার্ট, উদ্ধত ছবি, জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা আমার যদি বিয়ে হয়ে যায়, তুমি খুশি হবে ফোটোদাদা? অখুশি হবো কেন? শান্ত গলায় বলেছিল বিরাম। আমার তো আর মডেলিং হবে না। হুঁ। বিরাম অস্ফুট উত্তর দিয়েছিল।
হিহি করে হেসেছিল মেয়ে, তুমি আর আমাকে দেখতে পাবে না, আমি হয়ত ইউএস কিংবা ইউকে চলে যাব, তুমি মন খারাপ করে বসে থাকবে, ইউ আর দ্য অনলি পারসন হু ক্যান সি মায় বিউটি ইন সাচ আ ক্লোজ ডোর রুম। বিরামের কান গরম হয়ে গিয়েছিল- কী সোজা কথাই না বলতে জানে মুক্তামালা, একটু সময় নিয়ে বলেছিল, বলতে পারছি না কিছুই। কী চুপ করে আছ কেন? ক্যামেরার লেন্স আমি চিনি ফোটোওয়ালা, তোমার চোখও লেন্স। বুক ধক্ করে ওঠে বিরামের। সে এখন মধ্য পঞ্চাশ। তার মাথা ভরা চুল। লম্বায় সে প্রায় ছ’ফুট। শীর্ণকায়। তবে প্রশস্ত বুক তার। চোখে চশমা নেই। পড়ার সময় লাগে। এই মেয়ে এসেছিল তার ঠাকুরদার সঙ্গে। বৃদ্ধ তখন সত্তর। সবে আঠেরো। সবে কলেজের প্রথম বর্ষ। ছবি দরকার ছিল মুক্তারই। পাসপোরট সাইজ। দেখে অবাক হয়েছিল বিরাম। একেবারে প্রস্ফূটিত ফুল। বিরাম এইটুকু ভাবতে পারে। কবি হলে অনেক রকম উপমা দিতে পারত। তার সে ক্ষমতা নেই। একজন উলুঝুলু চুলের বছর চল্লিশের মানুষ এসেছিল সেই সময়, জানত অধ্যাপক, প্রফেসর। জ্ঞানী। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল বিরাম, আচ্ছা স্যার, ফিমেলের বিউটি কী রকম বলা যায়, সুন্দরী মেয়ে? লোকটি অবাক হয়ে তাকে দেখেছিল, কেন বলুন তো?
বিরাম বলেছিল কত মেয়েদের ছবি, ভালো ক্যাপশন যদি লিখে ডিসপ্লে করি, স্টুডিওর নাম হবে। লোকটা বলেছিল, কী বলল তা বুঝতে পারেনি বিরাম। সংস্কৃত। তখন লোকটা বলেছিল খাতা দিন। খাতায় লিখে দিয়েছিল যা, তা এখনো বিরামের কাছে রয়েছে… হিরক দশনা তন্বী, পক্ক বিম্বাধরা শ্যামা, আর সুদন্তিনী নিম্ননাভি ক্ষীণমধ্যা, চকিত হরিণী প্রায় চঞ্চল নয়না নিবিড় নিতম্বভরে মন্থর গমনা স্তনভরে আছে দেহ স্তোকন্ম্রা হয়ে
আরো বিবরণ দিয়েছিল লোকটি। মহাকবি কালিদাসের মেঘদূতম কাব্যের শ্লোক, বাংলা করেছে সে নাকি। কিন্তু ঐ শ্লোক লিখে ছবি ডিসপ্লে করলে স্টুডিও উঠে যেত। শুধু একটি লাইন নিয়েছিল সে। বড় ভালো লেগেছিল, ‘চকিত হরিণী প্রায় চঞ্চল নয়না’। এই মেয়ের মুখের ছবি তার শো কেসে জ্বলজ্বল করছে। এখনো আছে। তার ঠাকুরদাকে বলেছিল, এমন সুন্দর মুখ, ছবি তুলব...।
তারপর মুক্তার বাবা এলো একদিন সঙ্গে। মেয়ের রূপ আছে, মেয়ে কি মডেলিং করবে? বাবা মানুষটি হ্যাঁ করেছিল। তাঁরও প্যাশন ছবি তোলা। তবে একেবারে এমেচার। বললেন, আমাকেও ফোটো তোলা শিখিয়ে দেবেন। শেখাতে হয় নাকি, তুলতে তুলতে হবে। সেই তপন কুণ্ডু ছবি তুলত আর তার কাছে নিয়ে আসত। একবার উড়ন্ত পাখির ছবি তুলল। একবার গঙ্গার ঘাটের ছবি। জলে ঝাঁপিয়েছে দুরন্ত বালক। উড়ন্ত বালক। বিরাম বলেছিল, শিখে গেছেন আপনি। আসলে শেখেনি নতুন করে, জানত। তপন কুণ্ডু বলেছিল, দেখুন, ওর খুব ইচ্ছে অভিনয় করবে। বিরাম বলল, তুই কি প্রেম করছিস? হঠাৎ এ কথা? আর আসিস না, মাঝখানে তোকে ফোনেও পাইনি। ব্যস্ত ছিলাম, তোমার কল দেখেছিলাম, কিন্তু...। মডেলিং করতে বারণ করেছে সে? আমি কারো প্রেমে পড়তে পারি না ফোটোওয়ালা, একজন হয়েছিল ছ-মাস, কিন্তু তার জন্য মন উতলা হয় না কেন জানি না, সাতদিন দলে আসেনি, আমি একটি ফোনও করিনি। কেন, করিসনি কেন ? সে যে আসছে না, তা আমার মনেই আসেনি, তখন খুব রিহার্সাল চলছিল, তার ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিল। একে প্রেম বলে না। বিরাম বলল। বলে আঙ্কেল, তাকে দেখা মাত্র তাকে মনে পড়ে গেল, আবেগ উথলে উঠল, মনে হলো ভুলে ছিলাম কী করে অনিন্দ্যকে? ফোটোশ্যুট করবি তো, পাঠাতে হবে সেই পরিচালককে। তাঁর সঙ্গে দেখা করলেই তো হয়। বলল সুপ্তি। না, তিনি কয়েকজনকে নির্বাচন করে ডাকবেন। কেমন ফোটো, একরাশ গয়না পরে, মাথায় কাপড়- বউ? জিজ্ঞেস করল সুপ্তি। না, আটপৌরে কিন্তু সুন্দর, ওয়াইন হয়, আবার হয় না। সে আবার কেমন, এই তো আমি আটপৌরে হয়েই এসেছি, মহুয়া মহুয়া লাগছে না? তুই আজ নীল মুক্তাপরী, কী সুন্দর যে হয়েছিস! কী যে বলো তুমি ফোটোওয়ালা! মুখ ঘোরায় মুক্তামালা। বিরাম সাহার ক্যামেরা চোখ। শাটার মারল। ঝলক। মুখ তুলল মেয়ে, হাসল, কী ছবি তুললে? এমনি, সাইড থেকে, স্বাভাবিক। মুক্তা বলল, কিছু তো হচ্ছে না ফোটোওয়ালা। হবে, অপেক্ষা করতে হয়।
চুপ করে থাকে মুক্তা, তারপর বলল, কতদিন, মডেলিঙের ডাকও তো তেমন হয় না, আমি আর করব না। বিরাম সাহা ভাবছিল কত ছবি তুলেছে এই মেয়ের। এর ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন হয়েছিল। চশমা কোম্পানি। তারপর হলো থিয়েটার আর সিনেমার আকাঙ্ক্ষা। সাধ পূরণ হচ্ছে না সেখানে। শাড়ির বিজ্ঞাপনে ডাক পেয়েছিল। করেছিল। একবার মাত্র। তারপর আরো পেয়েছিল। কিন্তু পিছিয়ে এসেছে। সাহসী ছবি। সাহসী ছবি তুলেছে বিরাম। আবার মুছে ফেলেছে ওকে দিয়ে। ওর নিজের কাছে আছে হয়তো। কিংবা মুছে দিয়েছে। বিরাম বলল, কথা বলছিস না যে? হবে না। কী হবে না? হবে না ফোটোওয়ালা, আমাকে কেউ নেবে না। বিমর্ষ গলায় বলল মুক্তামালা। নেবে, নেবে, আজই তুলে নিই ছবি, পরে কবে আসবি, জানি না।
বিরাম সাহা ভাবছিল ভাগ্যে হয় অনেক কিছু। এমন মুখ, এমন চঞ্চল হরিণীর মতো চোখ, পক্ক বিম্বাধরোষ্ট, স্তনভারে স্তোকনম্রা... তিনি যা লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন, সব মিলে যায়। বিরাম যেমন বলেছে তেমন ছবি তুলেছে। তুলে নিজেকে দেখে বলেছে মুছে দি, ক্যামেরা দাও। তাহলে যে তুললি? দেখছি ওই সব প্লে-বয় ম্যাগাজিনে আমি মানাব কিনা, আমাদের এখানে ওসব হয় না, আমি কী করতে পারব জানি না।
বিরাম সাহার কথায় এই মেয়ে সেজেছে, সাজ খুলেছে। পোশাক পরেছে, আবার অনাবৃত হয়েছে। বিরাম সাহা কি চঞ্চল হয় নি? হয়েছে। মুক্তা একদিন আচমকা বলেছিল, আমি জানি। কী জানিস? তুমি আমাকে ভালোবেসেছ। সে কথাটা যেন ভাসিয়ে দিয়েছিল বাতাসে। না। বিরাম প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছিল। কিন্তু মুক্তা তার অস্বীকার মানেইনি। বলেছিল, তুমি ভীরু মানুষ, ভাবছ তোমার পেশা নষ্ট হয়ে যাবে, তুমি খুব ভালো গো, ভালো মানুষ। বিরাম বলেছিল, তুই তো আমার সন্তানের মতো। মিথ্যে বলো না ফোটোওয়ালা, তুমি আমাকে ডেকেছ কেন? মুক্তামালা ঘাড় তুলে জিজ্ঞেস করল। পুরোনো কথার সঙ্গে নতুন কথা মিশে গেল। বিরাম বলল, বললাম তো। না, পরিচালকের কাছে পাঠানোর মতো ছবি কি তোমার স্টকে নেই, কম্পিউটারে? নীলনয়ন নয়, ঈষৎ বাদামি এই মেয়ের চোখে মণি। আর সেই বাদামি চোখেই যত টান বিরাম সাহার। বিরাম ভেবেছিল অনেক দূর যাবে মুক্তামালা। কিন্তু পারছে না। বিরাম একটি ম্যাজিকের জন্য অপেক্ষা করছে। ম্যাজিক হয়ে যায়। আচমকা বড় একটা সুযোগ এসে যাবে। এসে যাবেই।
তুমি ডেকেছ কেন? জিজ্ঞেস করল মুক্তা। তুই এলি কেন? বিরাম পাল্টা জিজ্ঞেস করল। বাহ, ডাকলে আসব না? অনেকদিন তোর ছবি তুলিনি, তাই। তাহলে সিনেমার পরিচালক মিথ্যে? মিথ্যে না, সত্যিই ওয়াইনের জন্য শর্টফিল্ম, কথা হয়েছে আমি তার ফিচার ফিল্মের স্টিল তুলব, অনেকদিন বাদে সুযোগ এসেছে, তোর স্টিল পাঠাব, সে আমার স্টিল ফোটোগ্রাফি চেয়েছে, দ্যাখ একে একে দুই হয়ে যাবে। বিরাম বলল। তার মানে আমার জন্য নয়? প্রায় হিসহিস করে উঠল মুক্তা। আমার কাছে কত স্টিল আছে, তা থেকেই দিতে পারতাম, তোরটা দেব কেন তাহলে? উফ, ফোটোওয়ালা, তুমি কি না আমার কাছে লুকোচ্ছ!
বিরাম সাহা দেখল মুক্তোমালার নাসারন্ধ্র স্ফূরিত হয়ে উঠেছে। চোখের মণিতে আগুনে ভাব এসে গেছে। সে ভাবল এই মুহূর্তের ছবিটি যদি...। ক্যামেরা তাক করতেই দুহাতে মুখ ঢাকল। সেই ছবিই তুলে নিল বিরাম। তখন মুক্তোমালা বলল, ডিলিট দ্যাট পিকচার ছবিওয়ালা, আই সে ডিলিট...।
বিরাম দেখল ছবিটি। খুব ভালো উঠেছে। দারুণ! ছবিটি তার জন্য ভালো, আবার মুক্তোর জন্যও। অদ্ভুত অভিব্যক্তি। মহুয়া। মহুয়ার কথা মনে পড়ে গেল বিরামের। সে বলল, মহুয়া রায়চৌধুরী, তোর প্রিয় অভিনেত্রী, তার মতো। মুক্তামালা বলল, না মধুবালা। এই দেখে যা। তুমি এসো, দেখাও। তাকে যেন আদেশ করল মুক্তামালা। ঠোঁট চেপে হাসছে। বাদামি চোখের মণি ঘুরছে। বিরাম এগিয়ে গেল ক্যামেরা নিয়ে, ঝুঁকে পড়ল মুক্তার দিকে। সে বসেই আছে। এমনি মেজাজ এই মেয়ের। দেখে ঘাড় বাঁকিয়ে মাথা তুলে, হাঁসের মতো দেখল তাকে। হাসল, বলল, ভালো হয়েছে, মহুয়ার মতো, মাই ফেবারিট অ্যাকট্রেস। তুই আবার আসবি কবে? রিহার্সাল হচ্ছে, অনেক কাজ, নতুন নাটক নামবে। তাহলে আজ, আজই করে যা। হবে বলে এসেছি, অনেক সময় নিয়ে এসেছি। হবে, সালোয়ার কামিজ বদলে নে, আটপৌরে শাড়ি আছে…, লকার দেখে নে। হু জানি। বলল মুক্তামালা। আছে, আমি কাচিয়ে রেখে দিয়েছিলাম, গতকাল লকার দেখেছি, জানি তুই একদিনের বদলে দুদিন আসবি না।
হাসল মুক্তামালা, তুমি সব জেনে বসে আছ, হ্যাঁ, জানোই তো, ইয়েস জানো, ইউ ওল্ড ম্যান, তোমাকে না…, কিন্তু তুমি আমার লকার খুলেছ, কেন খুললে? কথায় শিহরিত হয় বিরাম সাহা, গা ছমছম করে, তারপর ধীরে ধীরে বলে, তোর লকার না খুললে আমি শাড়ি কাচতে দিতাম কী করে? তুই সেই পুজোর আগে এসেছিলি, তারপর এই। মাঝখানে লম্বা শীত গেল। তুই ফোনই ধরার সময় পাসনি।
শীতে শো থাকে বেশি, আর একবার ডুয়ারস, একবার সিকিম গেলাম, রেড ওয়াইন আমি খেয়েছি, নাইস, শীতের সময় উত্তাপ দেয় ছবিওয়ালা, কিন্তু ওয়াইনের বিজ্ঞাপন আটপৌরে হবে কেন? জানি না, তোর ফিল্মের কথা ভেবেছি আমি, হবে কিনা জানি না। হবে না। কিন্তু চেষ্টা করতে হবে? হ্যাঁ, দেখ পারো কিনা। ভিতরে ঢুকে গেল মুক্তামালা। পোশাক বদল করবে। তারপর সময় গেল। মহুয়া রায়চৌধুরী হয়ে আসবে মুক্তামালা। সমস্ত ফ্ল্যাট কুকিং গ্যাসে ভরে গিয়েছিল। মহুয়া অকালে ঝরে গেল। মধুবালার হৃদপিণ্ডে ছিদ্র ছিল, অকালে ঝরে গেল। অপেক্ষা করছে বিরাম। মেয়েটা অদ্ভুত, বলেছিল, তোমায় না, একদিন আমি…, একদিন হোয়াটস আপে লিখেছিল, আই রেসপেক্ট ইউ ফোটোওয়ালা, কিস ইউ ফোটোওয়ালা, তুমি অনেকদিন বেঁচে থেক, অনেকদিন, আমি বুড়ি হয়ে গেলেও তুমি ছবি তুলে দেবে। পাগল নাকি তুই। ইয়েস ফোটোওয়ালা। গুড নাইট। আমি এখন পড়ব, রাতে আমি বই পড়ি, মান্টোর নাম শুনেছ ফোটোওয়ালা? না, কে মান্টো? সাদত হোসেন মান্টো, উর্দু লেখক, পাকিস্তানে গিয়ে লেখার জন্য জেল খেটেছিলেন, মুম্বইয়ে থাকতেন। জানি না, আমি মুম্বইয়ের রাধু কর্মকারকে দেখেছিলাম, আর কী যেন মিস্ত্রি, বড় সিনেমাটোগ্রাফার, মনে নেই, ভেবেছিলাম মিঠুনের মতো বোম্বে মানে মুম্বই চলে যাব, সাহস হয়নি।
শাড়ি নয়, অদ্ভুত এক কালো শালোয়ার পরে এলো মুক্তামালা। কোথায় পেল? লকারে তো ছিল না। ছিল শাড়ি ব্লাউজ শায়া একসেট। আর লাল হলুদ সিল্ক। কালো শালোয়ার কোথা থেকে এলো? কালো শালোয়ারের একটা গল্প শুনেছিল বিরাম। বলেছিল এই মুক্তা। কেন বলেছিল মনে নেই। মনে সম্পূর্ণ কালোয় তার আপত্তি ছিল, কিন্তু মুক্তা বলেছিল, আমার কিছুই হবে না ফোটোওয়ালা, আমি সেই মেয়েটা হবো ছবিওয়ালা। সে এক ভয়ানক কষ্টের গল্প। স্বাধীনতার সময়ের গল্প। মুক্তামালা এসে বলল, তোলো ছবি, ব্ল্যাক শালোয়ার, কালি শালোয়ার।
কালো শালোয়ার এবং মাথায় ওড়না জড়ান মুক্তামালা। এই ছবি তুলবে কেন মুক্তামালার? শোকের পোশাক। সব কালো। মুসলমান, খ্রিস্টান মেয়েদের শোক। তুই এইটা পরবি কেন রে! এই ছবি কি ওয়াইনের বিজ্ঞাপনে যায়? তুমুল গোলমাল আরম্ভ হয়ে যাবে। মুক্তামালা বলল, ছবি তুলে দাও, আমি এসেছি ঐ জন্য, আমার দরকারে এসেছি, আমরা আমাদের বিজ্ঞাপন করব, ফ্লেক্সে শহর ভরিয়ে দেব, ‘আমাকে আমার দেশ দাও…,’ দিস ইজ দ্য মোমেন্ট...। হাত বাড়িয়ে আছে মুক্তামালা। মাথায় কালো ওড়না। ও এসেছে ঐ ছবি দিয়ে শহর ঘিরবে বলে। আজ মিছিলে যাবে। মিছিলে। মেয়েরা মিছিল করবে। সন্তান কোলে মা থাকবে, পুত্রীর হাত ধরে নানি, দাদি, সকলে কালো শালোয়ার পরে। ফোটোওয়ালা আমি থিয়েটার করি, মডেলিং করি, মনে রেখ, আয়াম অ্যান আরটিস্ট, শিল্পীর দায় নেই? এইটা হবে কালি ওয়াইনের বিজ্ঞাপন, আমার সন্তানকে দেশ দাও, ও মি. বিরাম সাহা- শুনছ!