জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ যতটা নীরব, সাম্প্রতিক সময়ে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ততোটাই অশান্ত মনে হচ্ছে। সব সরকারের আমলেই এ ধরনের ঘটনা আমরা দেখেছি। বৃহৎ দুই ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে একে অপরকে ধাওয়া করছে। কিন্তু নিকট অতীতে এ ধরনের ঘটনা কবে ঘটেছে মনে পড়ছে না। তাহলে হঠাৎ এমন কী ঘটলো যে, আমাদের এমন দুঃখজনক ঘটনা আবার দেখতে হচ্ছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনায় সিপিবির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে বলেন, ‘৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পরও রাজনৈতিক সরকারগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে এক বধ্যভূমিতে রূপান্তরিত করেছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা ব্যাহত করেছে, ভিন্নমতের চর্চার সুযোগ সংকুচিত করেছে, হলগুলোতে তাদের সমর্থকরা দানবের ভূমিকা নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। সংসদ নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে।’
এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। প্রশাসন সরকারি ছাত্র সংগঠনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করছে বলেও বিভিন্ন পত্রিকায় খবর এসেছে। ফলে ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নয়, একক কর্তৃত্বের দাপট চলছে এবং এটি পাকাপোক্তভাবেই হচ্ছে। অবাক করা বিষয় হলো, ঘটনা যাই ঘটুক, এগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত সোনার পাথর বাটি। যদিও প্রতিবারই এ ধরনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে শিক্ষাঙ্গণে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানানো হয়। কিন্তু এই দাবি রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া কিছু নয়।
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের শিক্ষার্থীরা উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে অসভ্য উদাহরণ সৃষ্টি করছে তা জাতির জন্য লজ্জাজনক। দুঃখজনক হলো এ জন্য সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নাম বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। দিন শেষে এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এখন কথা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পবিত্র স্থানে হানাহানির মতো ঘটনা কি ঘটতেই থাকবে? স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা এসব দেখে কী শিখছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তারাও কি একই আচরণ করবে না! এই যে অসহিষ্ণু আচরণ, বিরুপ তীব্র প্রতিক্রিয়া সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে- এর শেষ কোথায়?
হিন্দী সিনেমার সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দেখে তরুণরা যেমন বিপথে যাচ্ছে, আমাদের স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও তাদের বড় ভাই-বোনদের কাছ থেকে তাই শিখছে। সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অবশ্য বলছেন, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখা ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপদ শিক্ষাজীবন নিশ্চিতের স্বার্থে সব মতের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বস্তুত এই কথাটিই বিপজ্জনক। কারণ শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। শিক্ষার্থীদের এ কাজ করতে গেলে সংঘাত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়, এবং সেই সংঘাতময় পরিস্থিতি এ কারণেই তৈরি হচ্ছে।
এতে কে লাভবান হচ্ছে ভাবতে হবে। জিতে যাওয়ার এই দৃশ্যমান লাভ যে কত বড় ক্ষতির কারণ সেটি আমরা কেউ চিন্তা করি না। আমরা এই কথাটি মেনে নিতে পারি না, শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনের অধিকার যে কোন ছাত্র সংগঠনের থাকা উচিত, বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে উদারমনা, উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড চর্চার জায়গা, যা শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব শেখাবে- এই সুযোগ সকলেরই থাকা উচিত। লাঠি, বাঁশ, হকিস্টিক, মাথায় হেলমেট হাতে অস্ত্র নিয়ে মহড়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শোভা পায় না।
বলাবাহুল্য এ ধরনের ঘটনা রাজনীতিতেও উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল বলছে, নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রেও অংশ হিসেবে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে ঢোকানো হচ্ছে পরিবেশ অস্থির করতে। বিএনপি বলছে, আগামী নির্বাচনের পথ পরিষ্কার করতে ছাত্রদলের ওপর হামলা করা হচ্ছে। এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ সময় রাজনীতির যে স্বাভাবিক উত্তাপ, ছাত্র রাজনীতিতেও তার প্রতিফলন ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে দুটি প্রধান ছাত্র সংগঠনেরই নিজস্ব এজেন্ডা আছে। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রদল চাইবে, ক্যাম্পাসে অবস্থান ধরে রেখে দলীয় নীতি অনুযায়ী সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করে আসা ছাত্রলীগও চাইবে না কোনভাবে তাদের একাধিপত্য খর্ব হোক। ছাত্রলাীগ-ছাত্রদলের এই সংঘাত আসলে জাতীয় রাজনীতিরই অংশ, যা আগামীতে আরও তীব্র হতে পারে বলেই মনে হচ্ছে।
প্রায় দুই বছর করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে অনেক সময় লাগবে। সবাই চেষ্টা করছে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। এমন সময় শিক্ষাঙ্গণে অস্থিরতা কাম্য নয়। একদল শিক্ষার্থীতে আমরা দেখছি শ্রেণিকক্ষের বাইরে মহড়া দিতে ব্যস্ত। আরেক দল ক্যাম্পাসেই প্রবেশ করতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে যদি লাঠিওয়ালা আর অস্ত্রধারী শিক্ষার্থীদের ম্যানেজ করতেই সময় যায়, তাহলে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষণার কাজ কখন করবে, কীভাবে করবে? আর তা হচ্ছে না বলেই তো এত অরাজকতা চারদিকে।
একটি দেশের সমাগ্রিক উন্নতির জন্য যেমন সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি, তেমনিভাবে ছাত্র রাজনীতিসহ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিও উন্নত হওয়া অপরিহার্য। একে অন্যকে দোষারোপের রাজনীতি, সংঘাত, সহিংসতা কোনভাবেই ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে না। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের কথাটি অনুধাবন করা জরুরি। এ কারণে এবারের সংঘর্ষের ঘটনা আমলে নিয়ে যেমন আইনগত পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে, তেমনিভাবে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ তৎপরতা বজায় রাখতে হবে।
মনে রাখতে হবে, ১৯৫২সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা অর্জন এবং দেশের বিভিন্ন সময়ে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গৌরবের। ছাত্রদের ভিন্ন মতের সহাবস্থান, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। ছাত্রসংগঠনগুলো অবশ্যই রাজনীতি করবে কিন্তু তারও আগে তাদের কাজ সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে, শিক্ষার উন্নয়নে সোচ্চার হওয়া। এসব কাজে তারা কেউই সময় দেয় না। তারা ব্যস্ত যার যার দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে। এতে দেশের স্বার্থ, শিক্ষার স্বার্থ সবই বিঘ্নিত হয়। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পরিবেশ থাকার কথা সেটি থাকে না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা অস্বস্তি ও শঙ্কা বোধ করে। শিক্ষকবৃন্দেরও এসব পরিস্থিতিতে খুব একটা কিছু করার থাকে না। তবে, তারা সবাই মিলে চাইলে অনেক কিছুই করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব রয়েছে এসব ক্ষেত্রে। কিন্তু আমরা কী দেখলাম? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অজ্ঞাতনামা ৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এভাবে সমস্যার সমাধান মিলবে না। আসলে শিক্ষার যে সংস্কৃতি সেটি আগে ফিরিয়ে আনতে হবে। নইলে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অপরাজনীতির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না। করোনা আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে। রাজনীতির কারণে উচ্চতর পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হোক সেটা কেউই অন্তত চাইবে না।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক