সারা বাংলা

মাকে নিয়ে হজে যেতে চেয়েছিলেন ফায়ার ফাইটার শাকিল

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে লাগা আগুন ও বিস্ফোরণে মারা যাওয়া ফায়ার ফাইটার মো. শাকিল তরফদার (২৩) তার মাকে হজ করতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আগামী ঈদুল আযহায় তার গ্রামের বাড়িতে আসার কথাও বলেছিলেন মাকে। কিন্তু এখন সবই স্বপ্ন হয়ে গেছে। নিজের আদরের সন্তান আর বেঁচে নেই এটি কোনোভাবেই মানতে পারছেন না মা জেসমিন বেগম।

শনিবার রাত ৯টার দিকে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। ঘণ্টা দুই পর রাসায়নিক থাকা কয়েকটি কনটেইনারে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এ সময় আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের ফায়ার ফাইটার শাকিল তরফদার নিহত হন। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের আরো ৮ সদস্য নিহত হয়েছেন।

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সুখদাড়া গ্রামে নিহত শাকিল তরফদারের বাড়ি। গ্রামের এই বাড়িটি এখন সবার কেন্দ্রবিন্দু। রোববার (৫ জুন) সকাল থেকেই আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবসহ প্রতিবেশিরা শাকিলের খবর নিতে এই বাড়িতে ছুটে আসতে শুরু করেন। বিকেলের মধ্যে শাকিলের মৃত্যুর খবর পৌঁছে যায় গ্রামে। এরপর থেকে বাড়িটিতে চলছে শোকের মাতম।

সোমবার (৬ জুন) সকালে শাকিলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বৃদ্ধ বাবা আব্দুস সাত্তার তরফদার এবং মা জেসমিন বেগমসহ আত্মীয়-স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। শুধুমাত্র ছেলের কথা স্মরণ করে তারা আক্ষেপ করছেন। 

শাকিলের মা জেসমিন বেগম বলেন, ‘আগুন নেভাতে যাওয়ার আগে শাকিল আমাকে ফোন করেছিল। এ সময় সে দোয়া চেয়েছিল। আগামী কোরবানির ঈদে বাড়ি এসে খুলনা জোনের মনিরামপুর ফায়ার সার্ভিসের অফিসে যোগদানের কথা বলেছিলেন আমাকে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সে আমাকে নিয়ে হজে যেতে চেয়েছিল। ঈদে বাড়ি আসার কথা বলেছিল। কিন্তু এখন সবই স্বপ্ন হয়ে গেল।’

শাকিলের বাবা আব্দুস সাত্তার তরফদার রাইজিংবিডিকে বলেন,  ‘সাড়ে তিন বছর আগে শাকিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে ফায়ারম্যান হিসেবে যোগ দেয়। এরপর থেকেই সে পরিবারের সব দায় দায়িত্ব বহন করতো। অবিবাহিত শাকিলকে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। আজও (সোমবার) তার জন্য মেয়ে দেখতে একটি বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল আমাদের। শাকিল বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গা ভরাট করে সেখানে পাকা ভবন করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হবে না। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন- তিনি যেন আমাদের পাশে থাকেন।’ 

শাকিলের ভাই ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত মো. আসাদুজ্জামান রিপন জানান, তিনি অস্থায়ীভাবে ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত আছেন। ছোট ভাই শাকিল মূলত পরিবারের ভরণপোষণ ও মা-বাবাকে দেখা শোনা করতো। তাকে নিয়ে পরিবারের সবার একটি স্বপ্ন ছিল। যা আজ মিথ্যা হয়ে গেল।

শাকিলের মামা খালিদ হোসেন বলেন,  ‘পরিবারটি যাতে ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে সেজন্য সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’

সুখদারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘শুরু থেকেই শাকিল সীতাকুণ্ডের কুমিরা অফিসে দায়িত্ব পালন করছেন। চাকরির প্রথমবার শাকিলের মনিরামপুরে বদলি হওয়ার কথা ছিল। কোরবানির ঈদের পর সেখানে যোগদানের কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই শাকিল পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। তার মৃত্যুতে পরিবার ও প্রতিবেশীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।’

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালের ৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন শাকিল তরফদার। তিনি বাবা-মায়ের তিন ছেলের মধ্যে সবার ছোট। তার বড় ভাই মনিরুজ্জামান মনি তরফদার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। মেজো ভাই আসাদুজ্জামান রিপন তরফদার ফায়ার সার্ভিসে কুক হিসেবে কাজ করেন।

শাকিল ২০১৬ সালে ডুমুরিয়া উপজেলার গজেন্দ্রপুর জিকে এসকে আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১৮ সালের বটিয়াঘাটা সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাশ করেন। তিনি ২০১৯ সালের ২০ মে ফায়ারম্যান হিসেবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে যোগদান করেন।

জানা গেছে, শাকিলের বড় ভাই মনি তরফদার স্থানীয় কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে গেছেন। লাশ প্রাপ্তি সাপেক্ষে জানাজা এবং দাফন সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা।