খেলাধুলা

ওয়ানডেতে অদম্য বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টিতে কেন দুর্বল?

বল ও সাইটস্ক্রিণের একই রঙ। প্রতিপক্ষও একই। তারপরও আন্তর্জাতিক ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে কেন আকাশ-পাতাল তফাৎ? ঢাকায় বসবাসকারী যে কোনো ক্রিকেট বিশ্লেষকের কাছে এই প্রশ্নটা করুন, আপনি দুটো সাধারণ জবাব পাবেন। ঢাকা লিগ খেলা হয় ওয়ানডে ফরম্যাটে এবং এটা এখানকার অন্য যে কোনো লিগের চেয়ে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এটাই আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে স্বাচ্ছন্দ্যের অনুভূতি এনে দিয়েছে। আরেকটি কথা বলবেন সবাই যে বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি আসলে ওয়ানডে সংস্কৃতি। তাই এই ফরম্যাটে বাংলাদেশ তুলনামূলক ভালো খেলে।

এই ধরনের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আপনি সত্যিই দ্বিমত পোষণ করতে পারবেন না। কিন্তু শুধু এটাই বাংলাদেশকে ওয়ানডেতে অদম্য করে তোলেনি এবং অন্য ফরম্যাটে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ফেলেনি। সেখানে অবশ্যই অন্যকিছু কারণ এবং সমস্যাও আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি খেলোয়াড়দের মানসিক শক্তিমত্তার সঙ্গে এটি সম্পর্কিত।

টি-টোয়েন্টিতে একজন ব্যাটসম্যানকে প্রথম বল থেকে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে হয়। কিন্তু রক্ষণাত্মক মানসিকতা নিয়ে কোনো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান এটা করতে পারেন না। তারা উইকেটে থিতু হতে সময় নেয় এবং অনেক সময় নষ্ট করে। যদি একটি বা দুটি উইকেট পড়ে যায়, তখন তারা রক্ষণাত্মক হয়ে পড়ে। এটা প্রতিপক্ষকে আরও সুবিধা করে দেয় এবং দেখি বাংলাদেশের ধসে পড়া ব্যাটিং চিত্র! 

বাংলাদেশি মানসিকতার বোঝার অন্যতম সেরা উদাহরণ মুশফিকুর রহিম। তিনি আক্রমণে যেতে ম্যাচের শেষ দুই বা তিন ওভার কে বেছে নেন। যদি সুযোগ পান এবং সফল হন তাহলে ভালো কিন্তু বেশিরভাগ সময় তিনি সেই পর্যন্ত সুযোগ পান না।

এবার বোলিং প্রসঙ্গে ফিরি। বাংলাদেশি বোলাররা বেশিরভাগ সময় প্রতিপক্ষের আক্রমণের মুখে নিজেদের হারিয়ে ফেলে। তারা জানে না কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়।

সাম্প্রতিক টি-টোয়েন্টির দিকে তাকালে দেখা যাবে বাংলাদেশের বিপক্ষে এই  কৌশলই ভালোভাবে প্রয়োগ করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বেশিরভাগ সময় তারা ওভারের প্রথম বল থেকে বোলারদের আক্রমণ করেছে এবং সফল। অন্যদিকে প্রথম কয়েকটি বল ঠেকিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা চাপে পড়ে যায়। সেই চাপ থেকে বের হতে নির্দিষ্ট রান রেট ধরে রাখতে প্রতি ওভারের পঞ্চম কিংবা শেষ বলে চার-ছয় মারার চেষ্টা করে।  কিন্তু এই চেষ্টায় অধিকাংশ সময় দল ব্যর্থ। প্রতিপক্ষের সঙ্গে এটাই বড় পার্থক্য তৈরি করে দেয়।

ওয়ানডে ম্যাচে বিষয়গুলো ভিন্ন। প্রথম বল থেকে চার্জ করার তাড়া নেই ব্যাটসম্যানদের। এটা বাংলাদেশকে সময় নিয়ে খেলতে সহায়তা করেছে এবং একটি বা দুটি বড় জুটি সহজে তারা তৈরি করতে পেরেছিল। 

বাংলাদেশি বোলাররাও ওয়ানডেতে একটি নির্দিষ্ট সুযোগ পায়। তারা প্রথম বল থেকে মার খায় না কারণ প্রতিপক্ষ ৫০ ওভারের খেলায় দ্রুত উইকটে হারানোর ঝুঁকি নিতে চায় না। তাই শুরুতে দেখে শুনে সমীহ করে খেলে। তাতেই বাংলাদেশি বোলাররা চাপ ছাড়াই বল করে এবং কিছু ডট বল দিয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে।

অবশ্য ভালো মানের দলের মুখোমুখি হলে বাংলাদেশ দল এটা সবসময় করতে পারে না এবং হেরে বসে। উদাহরণ তো হাতের কাছেই আছে। ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে দেখা গেছে ইংল্যান্ড, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলো কীভাবে শুরুর চাপগুলো মোকাবিলা করে বাংলাদেশের কাছ থেকে ম্যাচ বের করে নিয়েছিল। সেই বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে, তাদের প্রথম উইকেট পড়েছিল ১৮০ রানে। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম উইকেট পড়েছিল ১২১ রানে এবং দ্বিতীয়টি ৩১৩ রানে। পাকিস্তানের সঙ্গে প্রথম উইকেট ২৩ রানে তুললেও, দ্বিতীয় জুটি যোগ করে ১৫৭ রান। ইংল্যান্ডের প্রথম উইকেট নিয়েছিল ১২৮ রানে এবং দ্বিতীয় উইকেট ২০৫ রানে।

এই দলগুলো বাংলাদেশকে শুরুতেই চাপে ফেলেছিল এবং জিতেছিল সহজেই। আবার অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং  আফগানিস্তান সেটা করতে না পারায় হেরেছে বাংলাদেশের কাছে।। এটা করতে ব্যর্থ হওয়ায় নিউ জিল্যান্ডকেও বাংলাদেশের বিপক্ষে ভুগতে হয়েছিল। 

উদাহরণ হিসেবে বিশ্বকাপকে টেনে আনার কারণ এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ প্রায় প্রতিটি প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলে এবং বেশিরভাগই ভিন্ন ভিন্ন গ্রাউন্ডে। এই টুর্নামেন্টই একটি দলের ভালো ও খারাপ দিকগুলো তুলে ধরতে পারে যথাযথ ভাবে। 

ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দেখিয়েছিল যখন চাপে থাকে না তখন তারা খুব ভালো দল।  আর দুর্বল মানসিকতার কারণে প্রায় সময় বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টিতে বিপদ ডেকে আনে অন্যদিকে ওয়ানডেতে তারা খেলে আয়েশি মেজাজে। মানসিক শক্তিমত্তায় দুর্বলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তাই ওয়ানডে তে কিছু ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারে।    লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, নিউ এইজ এবং স্পেনের বার্তা সংস্থা ইএফই এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি।