কোনো শিরোনামে ছোট গল্পগুলোকে এক করা যাচ্ছিল না। গল্পগুলো বেশ ছোট হলেও বিহাইন্ড দ্য সিন বিরাট কিছু। শেষ চার মাসে কাজী নুরুল হাসান যে দুরন্ত সময় পার করছেন তা কোনো গল্পকারের জন্য বিরাট রসদ। যে যাত্রায় ছিল উঠা-নামা, লড়াইয়ে ছিল তীব্র জেদ, নায়ক হবার অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছা এবং সবশেষে গ্ল্যাডিয়েটর হয়ে সোহানের আর্বিভাব।
শেখ জামাল-সোহান রসায়ন
২০১৮ সালে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের দায়িত্ব নেয় বসুন্ধরা গ্রুপ। সেই থেকে কাজী নুরুল হাসান সোহানের সঙ্গে শেখ জামালের পথচলা শুরু। পাঁচ বছর পর সেই জুটির শোকেসে ধরা দেয় অমূল্য ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা। গত মৌসুমে ঢাকা লিগের শিরোপা প্রথম জেতে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। পাঁচ বছরের দীর্ঘ পরিক্রমায় সোহান হয়ে উঠেন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শেখ জামালের দল গঠন, পরিকল্পনা তৈরি ও প্রণয়ন, অধিনায়কত্ব, ইন অ্যান্ড আউট দল সামলানোর সকল কাজ সিদ্ধহস্তে করেছেন এই ক্রিকেটার। ভবিষ্যৎ অধিনায়ক হওয়ার যাত্রা তার শুরু হয়ে যায় সেখানেই।
দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সফল হওয়ায় সোহান আর শেখ জামালের মুখে ছিল প্রাপ্তির আনন্দ। তাইতো মিরপুরে ট্রফি হাতে সেদিন বলেছিলেন, ‘শেখ জামাল শেষ ৪-৫ বছরে যে প্রক্রিয়ায় ছিল সেটারই ফল এটা। আমরা টি-টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। এছাড়া ২-৪ এর মধ্যে ছিলাম আমরা। এটার কৃতিত্ব সব ক্রিকেটারদের দেওয়া উচিত। সঙ্গে সানিয়ান ভাই (টিম ডিরেক্টর), মেহরাব ভাই তাদেরকেও কৃতিত্ব দিতে হবে। তারা আমার ওপর আস্থা রেখেছিল।’
সেই ১৩২ রানের ঝড়
শেষ দুই ওভারে প্রয়োজন ছিল ২৩ রান। সোহান এক ওভারেই ২৬ নিয়ে খেলা শেষ করে দিলেন ৬ বল বাকি রেখেই। ১৩২ রানে নট আউট শেখ জামালের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। ঢাকা লিগ দেশের ক্রিকেটের প্রধানতম প্রতিযোগিতা। এই লিগে এমন রোমাঞ্চকর ম্যাচের দেখা মেলে হরহামেশা। কিন্তু নিখুঁত ফিনিশিংয়ের অভাব অনুভব করা যায়। ব্যাটসম্যানরা বড় রান করেন কিন্তু শেষ করে আসতে পারেন না।
কিন্তু মিরপুরে সেদিন রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিলেন সোহান। রূপগঞ্জের দেওয়া ২৪৮ রান তাড়া করতে নেমে ৮১ রানে ৫ উইকেট নেই শেখ জামালের। সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে দুর্দান্ত স্কিল আর টেম্পারমেন্টের ছাপ রেখে সোহান একাই দলকে জেতান। ১১৮ বলে ১৩২ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলে শেখ জামালকে শিরোপার লড়াইয়ে রাখেন। যে বিধ্বংসী ইনিংস সাজানো ছিল ১০ চার ও ৫ ছক্কায়।
ঢাকার মাঠে দীর্ঘদিন পর স্থানীয় ক্রিকেটারের এমন ম্যাচ জেতানো ইনিংসে মুগ্ধ হয়ে যান সংশ্লিষ্টরা। ২০০০ সালের আগে ঢাকা লিগে স্থানীয়দের এমন পারফরম্যান্স চোখে লেগে থাকত। দিনভর চলত আলোচনা। পত্র-পত্রিকায় উঠত তাদের নাম। সোহান ১৩২ রানের নজরকাড়া ইনিংস খেলে সোনালী সেই দিনটিই যেন ফিরিয়ে এনেছিলেন।
এক সেঞ্চুরিতেই ২৫ লাখ টাকা পুরস্কার
বলা হয়, নায়করা জ্বলে উঠেন আসল সময়ে। সোহানের ক্ষেত্রে এই কথাটাই যেন প্রযোজ্য। ঢাকা লিগে শেখ জামালের হয়ে সুপার লিগে তার দোর্দণ্ড প্রতাপে স্রেফ এলোমেলো প্রতিপক্ষরা। ১৩২ রানের সেই নজরকাড়া ইনিংসের আগে পরে ব্যাট হাতে দাপুটে সময় কাটিয়ে ছয় ম্যাচে ৯৬-এর বেশি গড়ে ৪৮৩ রান করেছেন। এই ক্রিকেটারের পারফরম্যান্স দেখার পর বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান তাকে ২৫ লাখ টাকা পুরস্কার দেন। যা ছিল সোহানের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত, ‘ক্লাব থেকে তো আমরা বোনাস পেয়েছি প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো। আজ এখানে এসে তো স্তব্ধ হয়ে গেলাম। একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।’
জাতীয় দলে ফেরা ও জায়গা পাকাপোক্ত করা
ঢাকা লিগে অভাবনীয় পারফরম্যান্সের পর কাজী নুরুল হাসান সোহানকে আবার ফেরানো হয় জাতীয় দলে। শুধু ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টিতে নয়, সোহানের জায়গা হয় সাদা পোশাকেও। ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সবশেষ খেলেছিলেন তিনি। চার বছর পর আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজেই তার প্রত্যাবর্তন। এবার দ্যুতি ছড়িয়ে সোহান নিজের জায়গা পাকাপাকি করে নিয়েছেন। এরপর সীমিত পরিসরেও ভালো পারফরম্যান্সের পুনরাবৃত্তি। তাতে লাইমলাইটে চলে এসে নিজের সামর্থ্যের সবটুকু জানান দিতে পেরেছেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান।
হুট করেই আসলো অধিনায়কত্ব
ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স থাকলেও টি-টোয়েন্টিতে নেই দলগত অর্জন। সঙ্গে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর অফফর্ম। দুইয়ে মিলে মাহমুদউল্লাহ হয়ে উঠলেন প্রবল সমালোচিত। উপায়ন্তর না দেখে মাহমুদউল্লাহকে বিশ্রাম দেয় বিসিবি যা এক প্রকার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার উপায় মাত্র। নতুন অধিনায়ক হিসেবে বিসিবি বেছে নেয় সাকিবকে। কিন্তু জিম্বাবুয়ে সফরে সাকিব না যাওয়ায় সোহানকে দলনেতা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। হাসিমুখে এ ক্রিকেটারও বুঝে নেন নেতৃত্ব।
সোহানের বার্তা, ফিয়ারলেস ক্রিকেট
আগ্রাসী ব্যাটিং করতে পছন্দ করেন সোহান। বোলারদের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে অভ্যস্ত। অধিনায়কত্বেও সেই একই ছাপ রাখতে চান। ফলাফল কি হবে না ভেবে ফিয়ারলেস ক্রিকেট খেলতে চান। প্রক্রিয়া ঠিক রাখতে চান। দলের সবার সাফল্য উপভোগ করতে চান। ড্রেসিংরুমে রাখতে চান নিজের ছাপ। অধিনায়কত্বের যে গুণ তার মধ্যে রয়েছে তা দেখাতে চান বড় মঞ্চে।
আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে আজ সেসব কথাই বলেছেন বারবার, ‘এটা অবশ্যই গর্বের ব্যাপার। সামনে যে চ্যালেঞ্জটা আছে, সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি। খুব বেশি রোমাঞ্চ বা এসবের কোনো সুযোগ নেই। মনে হয়, দল হিসেবে সেরটাই দেওয়াই লক্ষ্য।’
‘ঘরোয়া ক্রিকেটে যখনই অধিনায়কত্ব করেছি, সব সময় আমার মাথায় একটাই চিন্তা থাকে, আমি সব সময় চাই যেন দল হিসেবে খেলতে পারি। আমি চাই জিম্বাবুয়েতেও যেন দল হিসেবে খেলতে পারি এবং মূল ব্যাপার হলো, দলের পরিবেশ যেন ভালো থাকে।’
‘আমার কাছে মনে হয়, ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই চেষ্টা থাকবে, সেটা যেন করতে পারি। ফল নিয়ে আগে থেকে চিন্তা অনেক সময় প্রক্রিয়া ঠিক থাকে না। প্রক্রিয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফল নিয়ে খুব বেশি কিছু চিন্তা করছি না। ফিয়ারলেস ক্রিকেট খেললে ইতিবাচক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। আপনি যখন ফিয়ারলেস থাকবেন, তখন অনেক অপশন বেরিয়ে আসবে। যখন মনের ভেতর কিছু নিয়ে ভয় কাজ করবে তখন অনেক কিছুই নেগেটিভ দিকে যায়। ভীতিহীন ক্রিকেচট খেলা খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে। দল হিসেবে যেন খেলতে পারি এটা নিশ্চিত করা।’
‘যে সুযোগটা পাবো অবশ্যই আমি চিন্তা করব সেখানে শতভাগ দেওয়ার। আমি এখন ফল নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করি না। প্রক্রিয়া ঠিক রেখে সততার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে চাই। সেটাই যেন দিতে পারি, ওই লক্ষ্য থাকবে।’