নড়াইলের লোহাগড়ায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের পর গত ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘ইমোশন কাজে লাগিয়ে একটি গোষ্ঠী অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। একটি ছেলের ফেসবুকের পোস্ট দেখে আবেগের (ইমোশনাল) বশবর্তী হয়ে নড়াইলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে।’
একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী হিসেবে জনমনে স্থান করে নিয়েছেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। বুঝে-শুনে তথ্য যাচাই-বাছাই করে তিনি ঠান্ডা মাথায় কথা বলেন- এটা প্রায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু শুধু আবেগের বশবর্তী হয়ে মানুষ, মানবতা ও একটি ধর্মের বিরুদ্ধে এত বড়ো আঘাত হানতে পারে- এটি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। পরিকল্পিতভাবে যারা এই অপকর্ম করেছেন তাদের মনে কি একবারও এই প্রশ্ন আসেনি- ঘরে মানুষ রেখে আগুন দেওয়া, সম্পদ লুটে নেওয়া, ভাঙচুর করা, দেবালয় ধ্বংস করা তিনি যে ধর্মে বিশ্বাসী সেই ধর্মেও এটি পাপ। শত শত হামলাকারী একসঙ্গে আবেগে ভেসে হামলা করলো? এদের মধ্যে একজনেরও কি বিবেক ছিল না? এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
ঘটনার পর আশপাশ থেকে যারা প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছেন তাদের মনে তো আবেগ কাজ করেনি। তাদের মধ্যে তো অনেকেই ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তারাও শুনেছেন ধর্মীয় অবমাননার জের ধরেই এই হামলা। তবে তাদের মনে আবেগ কেন কাজ করেনি? তারা কিন্তু তখন আবেগ নয়, বিবেককে প্রাধান্য দিয়েছেন। না হলে এই ঘটনা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত ভাবলেও বুক কেঁপে ওঠে।
তাদের তো উচিত ছিল ভাঙচুর, আর অগ্নিসংযোগে অংশ নেওয়া। আগুনের লেলিহান শিখায় যখন সবকিছু জ্বলছিল তখন আকাশে-বাতাসে অসহায় মানুষের গগণবিদারি আর্তচিৎকার শোনা গেছে। বিপদগ্রস্ত হয়ে কান্নায় ভেঙে পরা সেসব মানুষের ওপর চাইলে তারা আরো অত্যাচার চালাতে পারতো। কিন্তু তা না করে তারা সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করেছে। নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। আগুন নেভাতে সহযোগিতা করেছে। শুধু তাই নয়, পরে দুর্বৃত্তদের ঠেকাতে পাহারা বসিয়েছে। কেন মানবতার পথে হাটলেন তারা? কারণ একটাই তাদের মনে অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না। লুটপাটের ধান্দা মনে ছিল না। তারা মানুষ হিসেবে প্রকৃত কাজটিই করেছেন। এটাই বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি।
প্রশ্ন উঠেছে, দেশে যারা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ, তাদেরই কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, আর কারও ধর্মীয় অনুভূতি নেই? লোহাগড়ায় সনাতন সম্প্রদায়ের মন্দির ও প্রতিমা ভাঙা হলো, তাতে কি তাদের ধর্মীয় অনুভূতি আক্রান্ত হয়নি? তারা এর প্রতিকার পাবে? কেবল ভাঙা বা পুড়ে যাওয়া ঘর নির্মাণ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাদের হৃদয়ে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা কোনো কিছুতেই পূরণ হবে না। শত-শত বছরের সম্প্রীতি যেখানে বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে তা কীভাবে ভুলবে আক্রান্ত মানুষগুলো? যারা পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন তারাই বোঝে হৃদয়ে যন্ত্রণা কতোটুকু। এরকম ধারাবাহিক হামলার ঘটনা বন্ধ করতে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
গেল ১৪ বছরে বেশিরভাগ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুক-এ ধর্মীয় অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে। তদন্তে বেশিরভাগ ঘটনার সতত্য মেলেনি। অর্থাৎ ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে একটি গোষ্টী দেশের বিভিন্ন জেলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। যারা ধর্ম রক্ষার নামে অন্য ধর্মের মানুষের ওপর হামলা চালাচ্ছে, বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ করছে, মন্দির ভাঙছে- প্রকৃত অর্থে তারা কি ধার্মিক? তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ধর্ম রক্ষা নয়, ভিন্ন কিছু এটা নিশ্চয়ই সরকার এসব বোঝে। শুধু সরকার কেন, সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষেরও এসব কথা অজানা নয়। তারপরও একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
প্রতিটি ঘটনায় জড়িতরা সর্বদলীয় হলেও অনেক স্থানে এ ধরনের ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের লোকজনদেরও দেখা গেছে। এর চাইতে দুঃখের, যন্ত্রণার আর কী হতে পারে! সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা ১৪ বছর ধরে অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছি কাগজে কলমে আর সভা সেমিনারে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বীজ যারা ছড়িয়ে দেওয়ার পণ করেছেন তারা কিন্তু মোটেই বসে নেই। তারা কাজের কাজটুকু করছে পরিকল্পনামাফিক। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দেশকে। নতুন প্রজন্মকে কথিত ধর্মের আবরণে সাম্প্রদায়িক করে তুলছে। অর্থাৎ অপশক্তি বা দেশবিরোধী শক্তি প্রচন্ড সক্রিয়। কিন্তু করণীয় শক্তি নির্বিকার- এটা তো হতে পারে না।
নড়াইলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনার পর ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বাম নেতা রাশেদ খান মেনন এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘দেশের চারদিক তাকালে মনে হয় দেশটা আফগানিস্তান হয়ে গেছে, বাংলাদেশ নয়। যে ঘটনাগুলো ঘটছে এগুলো বাংলাদেশের চরিত্র নয়।’ একজন তুখোর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে বাংলাদেশের প্রকৃত চেহারা তার চোখ ফাঁকি দেবে এটা ভাবা যায় না। তিনি নিশ্চয়ই দেশে আফগানিস্তানের উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও তাদের সামাজিকতা, পোশাক আশাকের চিত্র লক্ষ করেছেন। সাদা চোখে সমাজের এমন বাস্তব চিত্র অনেকেরই দেখার কথা। তাহলে কী রাষ্টযন্ত্র তা দেখছে না? নাকি দেখেও না দেখার ভান করছে? অপশক্তিকে মোকাবেলা না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকা মানেই সামনে আরো বিপদ। কারণ বিরোধী শক্তি মাঠ তৈরি করে রেখেছে। ইস্যু সৃষ্টি করে উদ্দেশ্য সফল করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর থেকে এই উপমহাদেশে যারা সাহিত্য চর্চা করেছেন তাদের অনেকেরই লেখনিতে সেই সময় তুলে ধরা হয়েছে। সময়ের লেখনিতে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মে ধর্মে বিভেদ, হিংসা কমবেশি প্রকাশ পেয়েছে। অর্থাৎ এই ভূমিতে সাম্প্রদায়িকতা নতুন কিছু নয়। কখনও বেড়েছে, কখনও কমেছে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় মনে হচ্ছে আজ এই রোগ ক্যানসারে রূপ নিয়েছে। এই সত্য আওয়ামী লীগসহ অসাম্প্রদায়িক চেতনার সবারই বোঝা উচিত যে- উগ্র সাম্প্রদায়িকতা সমাজকে গ্রাস করে ফেলছে। যারা এসবের কুশিলব তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে বাংলাদেশের মূল চরিত্র ফিরিয়ে আনতে মাঠ পর্যায়ে সম্মিলিতভাবে কাজ শুরু করার এখনই সময়। আমরা ইতোমধ্যেই অনেক দেরি করে ফেলেছি।
মানুষ মাত্রই আবেগপ্রবণ। এই আবেগ থাক অসাম্প্রদায়িকতার নজির স্থাপনে, আবেগ থাক উন্নয়নে, সমৃদ্ধি আর বিজ্ঞানে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে। আবেগ থাকতে পারে সমাজ উন্নয়ন, মুক্তিযুদ্ধে মূলনীতি ও চেতনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ প্রতিষ্ঠায়। মনে রাখতে হবে ধর্মান্ধতা ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার আবেগ কখনও ভালো ফল আনবে না। বিজ্ঞানের এই যুগে এই আবেগের কোনো মূল্যও নেই। ধর্মীয় আবেগে সাম্প্রদায়িক হামলা, হামলার আগে লুটপাট, আগুন দেওয়া পৃথিবীর কেউ সমর্থন করবে না। এসব ঘটনা বিশ্ববিবেককে ধিক্কার দেয়, ঘৃণা জানায়। তাই সবার উচিত এ ধরনের আবেগ বর্জন করে মানবিক আবেগে নিজেকে গড়ে তোলা। মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। আবেগের এত বড়ো সর্বনাশ আর চাই না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক