হাওয়া চলচ্চিত্রটি দেখে এলাম। জেলেদের জীবন কাহিনি, খুনোখুনি, পিতা হত্যার প্রতিশোধ-এসব নিয়েই এই চলচ্চিত্র।
চাঁন মাঝির নেতৃত্বে নয়নতারা নামের মাছ ধরার বোট ভাসে সাগরে। এই বোটে সদস্য থাকে নয়জন। মহাজনকে না জানিয়ে চাঁন মাঝি ও তার সহকারী এজা মিলে নিজেদের কিছু বাড়তি আয়ের জন্য কয়েক খাচি মাছ অন্যত্র বিক্রি করতে চান। তবে বোটের ইঞ্জিন মেকানিক ইব্রাহিম তাতে বাধা দেন। ফলে তাকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেন চাঁন মাঝি আর এজা। তবে এই ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায় রহস্যময়ী এক তরুণীর কারণে। ওই তরুণী হঠাৎ জেলেদের জালে উঠে আসে। এরপর একটা করে ঘটনা ঘটে বোটে। বলা যায়, হাওয়ার গল্পে আছে ঘোর লাগা বাঁক, আছে মিথ।
‘হাওয়া’র গল্প হাওয়া চলচ্চিত্রের গল্প নতুন কিছু নয়। ব্যতিক্রমীও নয়। কি সেই গল্প? গল্পের শুরুটা হয় ডাঙায়। জেলেরা প্রস্তুতি নিচ্ছে মাছ ধরতে যাওয়ার। বোটে জাল, অন্যান্য সরঞ্জাম উঠাচ্ছে। বোট ছাড়ার অপেক্ষায়। এরই মধ্যে একজন ক্যানভাসার ক্যানভাস করছেন, ‘সমুদ্দুর কোনও সাইন্স মানে না। এর আগে দুইবার এই দরিয়ায় ‘মইরা গ্যাছে’। এরপরই আটজন মাঝি নিয়ে যাত্রা শুরু চাঁন মাঝির বোটের।
এই প্রজন্মের অনেকের কাছে হাওয়া চলচ্চিত্রের গল্প রূপকথার মতো মনে হতে পারে। বিশেষ করে যারা শহরে বড় হয়েছেন কিংবা যারা কখনো চর ও সমুদ্র পাড়ের বাসিন্দাদের জীবনচিত্র দেখেননি তাদের রূপকথার মতো মনে হবে। পরিচালক এখানে মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন। সমুদ্রের জেলেদের কাছে জীবনের একদম বাস্তবচিত্র তুলে ধরেছেন। চাঁন মাঝির বোট যাত্রা শুরু করে। যাত্রার শুরুরদিকে মাছও ভালো ধরা পড়ে জালে। তবে হঠাৎ এক রাতে জালে উঠে আসে এক বেদে তরুণীরে লাশ। প্রথমদিকে সবাই ধারণা করে ওই তরুণী মৃত। জেলেরা সবাই আলোচনা করে রাতে তরুণীর লাশ কী করবে? পানিতে ফেলে দিবে নাকি বোটে রেখে দিবে। মাছ জাল থেকে খাচায় ভরা শেষ হলে হঠাৎ এক জেলে দেখেন তরুণীর চোখ খোলা। তখন সবাই জানতে পারেন বেঁচে আছে ওই তরুণী।
‘হাওয়া’ সিনেমায় চাঁন মাঝি চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী
বোটে তরুণীর কারণে জেলেরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পরে ধীরে ধীরে তরুণীর সঙ্গে মেশার চেষ্টা করেন সবাই। তরুণী সঙ্গে ভাব জমাতে বোটের ইঞ্জিন মিস্ত্রি ইব্রাহিম রহস্যময় সেই তরুণীকে বোঝার চেষ্টা করেন। তবে বোবা হওয়ায় ইব্রাহিম প্রথমে দ্বিধায় পড়েন। পরে সময় যত যায়, তরুণীর সঙ্গে তার ভাব জমে। এক পর্যায়ে তরুণী কথা বলতে পারে এটা জেনে যায় ইব্রাহিম। তরুণীর নাম গুলতি। বোটে গুলতির ভালো বন্ধু হয় ইব্রাহিম।
চলচ্চিত্রটির বিরতির পর দর্শক বুঝতে পারেন তরুণীর (গুলতি) আগমনের রহস্য। চলচ্চিত্রে গুলতি মাছ থেকে মানুষ হয়ে আসে। চাঁন মাঝি তাকে নিরালায় ডেকে নিতে চাইলে সে বাধা দেয়। চান মাঝি গুলতি নামের অসহায় এই মেয়েটার প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারে না। অন্যদিকে ইঞ্জিন রুমের মিস্ত্রি যে আলাদাভাবে মাছ বিক্রির প্রতিবাদ করেন, চাঁন মাঝি যাকে দেখতে পারে না, মেরে ফেলতে চায়, তাকে ভালো লেগে যায় মেয়েটার অর্থাৎ গুলতির। মাঝ সমুদ্রে ভাসতে থাকা, ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাওয়া আর তেল ফুরিয়ে যাওয়ার দুঃসময়ে গুলতির প্রতি নজর থাকে সবার। তবু চিরাচরিতভাবে দোষ দেওয়া হয় নারীকে, নয়নতারা বোটের সব অমঙ্গল নাকি ওই নারীর কারণেই।
চাঁন মাঝি একটা পাখি পোষে। নাম শালিক। নিজে পানি পানের সময় পাখির খাঁচার খুরিতেও সে পানি ঢেলে দেন। ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে বোট আটকে থাকার সময় ওই পাখিটিতে উড়িয়ে দেন চাঁন। পাখির ফিরে না আসায় আশা খোঁজে। তারপর পাখি ফিরে আসে। পরে সেটিকে পুড়িয়ে খান চাঁন। এভাবে গল্প এগুতে থাকে।
হাওয়া চলচ্চিত্রে অনেকগুলো ওয়াইড শট আছে। শটগুলো রং, আলোছায়া আর কম্পোজিশনের সংমিশ্রণে কখনো পেইন্টিং বলে মনে হবে। গভীর রাতে বাতাসে উড়া শাড়ি আর নায়িকার চুল মিলেমিশে কখনো বা দৃশ্যটি হয়ে ওঠে অন্যরকম অনুরণন। লাইটিং, ছবির কালার গ্রেডিং, আবহ সংগীত বাস্তব আর জাদুবাস্তবতার মাঝামাঝি ঘোর জাগিয়ে রাখে। সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্যামেরার যে খেলা আর রঙের যে সংমিশ্রণ দেখা যায় তা উপভোগ্য। আপনি স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হবেন শুধু তাই নয়, চারদিকে পানি থৈ থৈ করছে, সমুদ্রের মাঝে একটা বোট ভাসছে- এরকম প্রত্যেকটা দৃশ্যই জীবন্ত মনে হয়েছে।
হাওয়ায় গুলতি নাজিফা তুষি
কিছু অসঙ্গতি হাওয়ার গল্প দারুণভাবে এগিয়েছে। তবে সমুদ্রের মাঝে অনেকদিন থেকেও গুলতিকে অনেক ফ্রেশ মনে হয়েছে। এখানে পরিচালক আরেকটু সচেতন হতে পারতেন। বিশেষ করে সমুদ্রে জেলেদের চেয়ে গুলতির লুকিং আরেকটু ডিপ করা যেত। স্বাভাবিকভাবে সমুদ্রে অনেকদিন থাকলে লাবণ্যময় চেহারাটা দৃষ্টিকুট লেগেছে। চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে হঠাৎ সাপের আগমনও বেমানান মনে হয়েছে। গুলতি, সাপ আর রাজের শুয়ে থাকার দৃশ্যও অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। রাজকে মারার পর মরদেহ অনেকদিন একই অবস্থায় থাকাটা বেখাপ্পা লেগেছে।
চাঁন মাঝি ডাকাত ছিল, সে গুলতির বাবাকে হত্যা করেছে। নয়নতারা বোটের সবাই কী ডাকাত বা চানমাঝির সহযোগী ছিল? যদি তাই না হয় তাহলে ৮ জনকেই মেরে ফেলা হলো কেন-বিষয়টি এখানে অস্পষ্ট।
হাওয়ার শক্তিশালী দিক কাহিনির বুনন ছিল এককথায় অনবদ্য। সিনেমাটোগ্রাফিও ভালো। নির্মাণশৈলী, চিত্রনাট্য এবং সেট ডিজাইন একদম নিখুঁত। ছিল সবার চমৎকার অভিনয়। চঞ্চল চৌধুরী (চাঁন মাঝি), শরিফুল রাজ (ইব্রাহীম), নাসির উদ্দিন (নাগু) এজা চরিত্রে সুমন আনোয়ার, উরকেস চরিত্রে সোহেল মণ্ডল, পারকেস চরিত্রের রিজু, মরা চরিত্রে মাহমুদ আলম, ফনি নামে বাবলু বোস দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। পরিচালকের প্রথম সিনেমা হলেও শিল্পসত্তার বুনন তৈরি করতে পেরেছেন।
গানে বাজিমাত ‘তুমি বন্ধু কালা পাখি/আমি যেন কী?/বসন্তকালে তোমায়/বলতে পারিনি। ’ গানটি (গীতিকার হাশিম মাহমুদ) ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সবার মুখে মুখে এই গান বাজছে। এটা আগামী দিনে বাংলা সিনেমার জন্য অনুপ্রেরণা। তবে ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ শিরোনামের এই গানটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে।
হাওয়া ছবির পোস্টার
হাওয়া প্রসঙ্গে কিছু কথা গত কয়েক বছরে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সংকট চলছে। এফডিসিকেন্দ্রীক সিনেমা আমাদের হতাশ করেছে। এফডিসিকেন্দ্রিক সিনেমা মাঝে মধ্যে মুক্তি পায় সেগুলো সাধারণ সিনেমা হলগুলোতে চললেও তাতে খুব একটা দর্শক দেখা যায় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশকিছু ছবি মুক্তি পেলেও বড় আকারে ব্যবসায়িক সফলতা পায়নি। চলচ্চিত্রগুলো অনেক আশা নিয়ে মুক্তি পেলেও প্রেক্ষাগৃহ মালিকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক প্রযোজকরাও হতাশ হয়েছেন। তবে গত কয়েক বছর ধরেই বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সিনেমা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ দেখা গেলেও তা খুবই কম। মেজবাউর রহমান সুমনের হাওয়া অনেক চেনা দৃশ্য বদলে দিয়েছে। বিশেষ করে হলভর্তি দর্শক কিংবা টিকিটের জন্য কাড়াকাড়ি-এমন দৃশ্য দেখা গেলো অনেক বছর পর। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে নতুন হাওয়া বইয়ে দিল ‘হাওয়া’। মেজবাউর রহমান সুমন ও তার টিমকে অভিনন্দন।
একনজরে হাওয়া ছবির পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন। প্রযোজক অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু। কাহিনি ও সংলাপ মেজবাউর রহমান সুমন। চিত্রনাট্য সুকর্ণ শাহেদ ধীমান। চিত্রগ্রাহক কামরুল হাসান খসরু। মুক্তির তারিখ ২৯ জুলাই, ২০২২। ফরম্যাট ডিজিটাল। রং রঙিন। ভাষা বাংলা।
আরও পড়ুন : রেহানা মরিয়ম নূরের শিল্পবোধ