মতামত

বঙ্গবন্ধুর ‘জয় বাংলা’

আবদুল আজিজকে নিয়ে আমি একটা গল্প লিখেছি। গল্পের নাম ‘আবদুল আজিজের জয় বাংলা’। আজিজের কথা শুনেছিলাম আমাদের মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। ওই অঞ্চলের একজন মুক্তিযোদ্ধা লেখকের লেখায়ও পড়েছিলাম তাঁর কথা। মনের মধ্যে গেঁথে ছিল সেই ঘটনা।

শ্রীনগর উপজেলার রাজদিয়া হাইস্কুলের শতবর্ষপূর্তি হলো কিছুদিন আগে। দুইদিনের আনন্দ উৎসব। একদিন আমি গিয়েছিলাম অতিথি হয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে গেলে আমি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি। ১৯৭১ কতটা দখল করে আছে বাঙালি জাতির হৃদয়, সেই কথা বলি। বলি আমাদের জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। একজন মানুষের ডাকে কীভাবে জেগে উঠেছিল বাঙালি জাতি, কীভাবে একত্রিত হয়েছিল, কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে, কীভাবে পাকিস্তানিদের নাস্তানাবুদ করে ছিনিয়ে আনল বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সেই কথা বলি। সেদিনও বলছিলাম। রাজদিয়া হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা চুপচাপ শুনছে। শিক্ষকরা শুনছেন, অভিভাবকরা শুনছেন। মঞ্চের অতিথিরা শুনছেন।

একসময় আমি আবদুল আজিজের কথা বলতে লাগলাম। ১৬/১৭ বছরের আবদুল আজিজ ছিল এই অঞ্চলের ছেলে। একাত্তরের একদিন সে গিয়েছিল সিরাজদিখান বাজারে। এমন সময় জিপ নিয়ে এলো পাকিস্তানি জন্তুরা। সঙ্গে আছে স্থানীয় কুলাঙ্গার রাজাকাররা। পাকিস্তানি প্রভুদের পিছু পিছু তারাও এসেছে গাড়ি ভর্তি করে। মিলিটারি আর রাজাকাররা আসছে শুনেই বাজারের লোকজন, যে যেদিকে পারে ছুটে পালিয়েছে। দোকানপাট ফেলে উধাও হয়ে গেছে দোকানিরা। চোখের পলকে ফাঁকা হয়ে গেছে সিরাজদিখান বাজার।  শুধু...

শুধু আজিজ পালাতে পারেনি। সে গিয়েছিল দিশেহারা হয়ে। কোন দিকে ছুটবে, কী করবে বুঝতে পারছিল না। জন্তুরা তাকে ধরে ফেলল। চারদিক থেকে ঘেরাও করে, ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে এলো পালের গোদাটির কাছে। সেই জন্তুটি আজিজের বুকে রাইফেলের নল ঠেকাল। উর্দুতে বলল, বল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। 

আজিজ মনে মনে বলল, আমি বাঙালি। আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু। তিনি শিখিয়েছেন, আমরা বলব ‘জয় বাংলা’। পাকিস্তান জিন্দাবাদ আমরা বলব না। ওটা আমাদের স্লোগান না। বঙ্গবন্ধু যা শিখিয়েছেন, আমরা তাই বলব।

রাজাকারগুলোর একটা বলল, সাহেবরা যা বলতে বলছেন সেইটা বল। ‘বল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। নয়তো গুলি করে মারবে।  আজিজ মনে মনে বলল, বঙ্গবন্ধু বলেছেন ‘রক্ত যখন দিয়েছি, আরও রক্ত দেব। এই দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ্’। আমি বঙ্গবন্ধুর দেশের লোক। তিনি আমার নেতা। আমি মৃত্যুকে ভয় পাব কেন? দরকার হলে রক্ত দেব, পাকিস্তানিদের স্লোগান দেব না। 

বুকে রাইফেলের নল ঠেকানো। আবদুল আজিজ সেদিকে ফিরেও তাকাল না। তোয়াক্কাও করল না। মুষ্ঠিবদ্ধ ডানহাত আকাশের দিকে তুলে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিল ‘জয় বাংলা’।  মিলিটারি আর রাজাকাররা হতভম্ব! বলে কী এই ছেলে? এত সাহস! রাইফেলের নলের মুখে বলছে ‘জয় বাংলা’! তাও এইটুকু একটা ছেলে! পালের গোদাটি রাইফেলের বাট দিয়ে মুখে মাথায় ঘাড়ে পিঠে মারতে লাগল আজিজকে। তার দেখাদেখি অন্যগুলোও ঝাঁপিয়ে পড়ল। আজিজের মাথা ফেটে গেল, নাক ভেঙে গেল, দাঁত পড়ে গেল অনেকগুলো। সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। জন্তুরা তাকে টেনে তুলল। পালের গোদাটি আবার বলল, ‘বল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। 

আজিজের শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। দাঁত প্রায় নেই মুখে। ঠোঁট কেটে ঝুলে পড়েছে। চোখ ফুলে প্রায় বন্ধ। সেই অবস্থায় অতি কষ্টে আকাশের দিকে হাত তুলল আজিজ। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল বঙ্গবন্ধুর মুখ। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে আজিজ আবার স্লোগান দিলো ‘জয় বাংলা’।  এবার ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেল জন্তুরা। আজিজের হাত দুটো ভেঙে দিলো। যেন হাত আর আকাশের দিকে তুলতে না পারে সে। আজিজ মাটিতে পড়ে আছে। ভারি বুট দিয়ে লাথির পর লাথি মারা হচ্ছে তাকে। গালাগাল করা হচ্ছে।

আজিজের তখন দম প্রায় ফুরিয়ে আসছে। এই অবস্থায় আবার টেনে তোলা হলো তাকে। পালের গোদাটি রাইফেলের বাট দিয়ে মারতে মারতে বলল, ‘বল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। বল, বল’।  আজিজের ঘাড় ঝুলে পড়েছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর, হাত নড়বড়ে অবস্থায় ঝুলছে, পা অচল। রাজাকাররা কোনো রকমে তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ঝাপসা হয়ে আসা চোখে আজিজ শুধু দেখছে একজন মানুষের মুখ, তার কানে বাজছে একজন মানুষের কণ্ঠস্বর। সেই মানুষ বঙ্গবন্ধু। সেই কণ্ঠস্বর বঙ্গবন্ধুর।  আবদুল আজিজ শেষ বারের মতো উচ্চারণ করল ‘জয় বাংলা’।  সঙ্গে সঙ্গে গুলি। আজিজের রক্তাক্ত শরীর লুটিয়ে পড়ল বাংলার মাটিতে। 

রাজদিয়া স্কুলের শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যখন আবদুল আজিজের কথা আমি বলছিলাম, শুনতে শুনতে কাঁদছিল ছাত্রছাত্রীরা, চোখ মুছছিলেন অভিভাবক আর শিক্ষকরা। আমার নিজের চোখও ভিজে গেছে। মঞ্চ থেকে নামার পর একজন প্রবীণ শিক্ষক এসে বললেন, আবদুল আজিজ আমাদের এই  স্কুলের ছাত্র ছিল। একাত্তর সালে সে ক্লাস নাইনে পড়ত।

আবদুল আজিজের কথা ভাবলে একটা কথাই আমার শুধু মনে আসে, আমাদের বুকে রাইফেলের নল ঠেকালেও, মৃত্যু অবধারিত জেনেও আমরা আমাদের চেতনা থেকে ফিরব না। সেই চেতনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমাদের রক্তে আর অন্তরে এই চেতনা তৈরি করে দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু।