২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ইন্ধনে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশসহ (হুজি) তিনটি জঙ্গি সংগঠন ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় বলে তদন্তে উঠে আসে।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় ইতিহাসের ভয়াবহতম নৃশংস ও বর্বরোচিত ওই হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দলের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন কয়েকশ নেতাকর্মী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান।
আজ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার ১৮ বছর পূর্ণ হলো। ভয়াবহ সেই ঘটনার ১৪ বছর ১ মাস ২০ দিন পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর মামলা দুটির রায় ঘোষণা হয়। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর তৎকালীন বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে স্থাপিত আদালতে এ রায় ঘোষণা করেন। হত্যা মামলায় ১৪টি এবং বিস্ফোরক আইনের মামলায় ১২টি বিষয় বিবেচনা করা হয়। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, এনএসআইয়ের সাবেক দুই মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিমসহ ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ আসামিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া রায়ে আনসার ও ভিডিপির সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, সাবেক তিন আইজিপি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরীসহ ১১ জন সাবেক সরকারি কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
নিয়ম অনুযায়ী রায়ের পরপরই ফাঁসির আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পাঠানো হয়। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাা দুই মামলার রায়সহ প্রায় ৩৭ হাজার ৩৮৫ পাতার নথি ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এসে পৌঁছায়। পরে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য মামলার পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সেই আদেশের ধারাবাহিকতায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাড়ে ১০ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়।
আসামিদের মধ্যে ২২ জন খালাস চেয়ে আপিল করেছেন। অপরদিকে ১২ জন আসামির জেল আপিল দায়ের হয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালতে আলোচিত এ মামলার আপিল শুনানি এখনো শুরু হয়নি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্স এখনো ঝুলে আছে। আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ায় সরকার রায়ও কার্যকর করতে পারছে না।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, মামলাটি এখন হাইকোর্টে বিচারের অপেক্ষায় আছে। এরই মধ্যে মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। তার কারণ হচ্ছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট হামলার মাধ্যমে রাষ্ট্রের একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। মামলাটি শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে একটি দরখাস্ত করেছি। প্রধান বিচারপতি একটি বেঞ্চ ঠিক করে দেবেন।
তিনি বলেন, ডেথ রেফারেন্স হিসেবে যে মামলাগুলো হাইকোর্টে আসে, সেগুলো কিন্তু প্রধান বিচারপতি নির্দিষ্ট করে হাইকোর্টের বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। পরে সেই বেঞ্চেই শুনানি হয়। সে কারণে আমরা প্রধান বিচারপতির কাছে একটি দরখাস্ত করেছি এই মামলাটি শুনানির জন্য, যেন একটি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন। আশা করছি আগামী অক্টোবর মাসে মামলাটি শুনানির জন্য একটি বেঞ্চ ঠিক করে দেবেন তিনি। আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা এখন হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় আছে। আমরা আসামিপক্ষ থেকে শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি। কার্যতালিকায় এলে আমরা শুনানি করব। আমরা মনে করি, মুফতি হান্নানের মাধ্যমে এই মামলায় বড় নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। এই মামলায় তারেক রহমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আজ্ঞাবহ তদন্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে তাদেরকে সম্পৃক্ত করা হয়। রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্যই তাদের এ মামলায় চার্জশিটভুক্ত করা হয়েছে। উচ্চ আদালতে আপিল শুনানিতে আমরা এসব বিষয় তুলে ধরব।
উল্লেখ, গ্রেনেড হামলার ঘটনায় রাজধানীর মতিঝিল থানায় পৃথক চারটি মামলা করা হয়। ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট রাজধানীর মতিঝিল থানায় এসআই ফারুক আহমেদ, শেখ হাসিনার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিল বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা করেন। ওই বছরের ২০ অক্টোবর একই থানায় আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বাদী হয়ে অন্য মামলাটি করেন। মামলাগুলো একত্রে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। হামলার দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয় আওয়ামী লীগের ওপর। সাজানো হয় ‘জজ মিয়া’ নাটক। বিষয়টি ফাঁস হয়ে পড়ায় মামলার কার্যক্রম থেমে যায়। পরে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। ২০০৮ সালের ১১ জুন আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডির সিনিয়র এএসপি ফজলুল করিম। এতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর একত্রে চার মামলায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে পৃথক দুটি চার্জ গঠন করেন আদালত। ১৭ নভেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ২০০৯ সালের ৯ জুন ৬১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। এরপর ২০০৯ সালের ২৫ জুন অধিকতর তদন্তের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আদালত ওই বছরের ৩ আগস্ট অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। ২০১১ সালের ৩ জুলাই তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে নতুন আসামি করে সম্পূরক চার্জশিট দেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ। ২০১২ সালের ১৮ মার্চ দ্বিতীয় দফায় চার্জ গঠন করেন আদালত। ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে জজ মিয়া নাটকের অবসান হয়। ২০১৭ সালের ৩০ মে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ওই বছরের ১২ জুন আত্মপক্ষ সমর্থন ও ২৩ অক্টোবর যুক্তিতর্ক শুরু হয়। ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়।
হামলায় নিহত যারা : আইভি রহমান, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, আওয়ামী লীগ কর্মী রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগমসহ ২৪ জন নিহত হন।
হামলায় আহত যারা: বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেনসহ আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতাকর্মী আহত হন।