একজন সফল উদ্যোক্তা সফিকুল আলম সেলিম। যার হাত ধরে বৈশ্বিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে রংপুরের শতরঞ্জি। ১৯৯১ সালে ‘কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড’ সেলিমের মাধ্যমেই বিশ্ববাজারে প্রবেশ করে।
এরই ধারাবাহিকতায় রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি ভৌগলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিকাল আইডেন্টিফিকেশন বা জিআই) স্বীকৃতি পায় ২০২১ সালের জুন মাসে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) এই স্বীকৃতি দিয়েছে।
‘জিআই’-এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সেলিম জানান, কোনো পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যদি সেই দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এবং সেই দেশের জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে- তাহলে সেই পণ্যকে সেই নির্দিষ্ট দেশের ‘জিআই’ পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যার কারণে অন্য কোনো দেশ সেই পণ্যটিকে নিজেদের পণ্য বলে দাবি করতে পারে না। জিআই স্বীকৃতির কারণে বর্তমানে বিশ্ববাজারে এই পণ্যের চাহিদার পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি রপ্তানিও বাড়বে। ফলে আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে। রপ্তানি করে আয় হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।
ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জির জিআই প্রাপ্তির আনন্দঘন উদযাপন অনুষ্ঠানে অতিথিরা
সোমবার (২৯ আগস্ট) রাতে রাজধানীর শুক্রাবাদের নন্দিনী ভবনে এই প্রাপ্তির আনন্দঘন উদযাপন এবং নতুন সুবিশাল প্রদর্শণকেন্দ্রের উদ্বোধন উপলক্ষে উপস্থিত হন বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনরা। অনুষ্ঠানে শতরঞ্জির অতীত, বর্তমান, ঐতিহ্য এবং এর ধারাবাহিক বিবর্তনের ইতিহাস শোনান উদ্যোক্তা সফিকুল আলম সেলিম।
গত তিন দশক ধরে শতরঞ্জি নিয়ে কাজ করা সফিকুল আলম সেলিম শতরঞ্জির পাশাপাশি দেশের অন্যান্য হস্তশিল্পের সম্ভাবনার জায়গাটিও তুলে ধরেন। সুবিশাল শোরুমে মধ্যে পাট, বাঁশ, কাশিয়া, লোহা লক্কড় ও কচুরিপানাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া কাঁচামাল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্য প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা করেন। যা দেখে মুগ্ধ হন উপস্থিত দর্শকরা। এসব পণ্য দেশীয় বাজারের পাশাপাশি অনেকদিন থেকেই স্থান করে নিয়েছে ইউরোপের বাজার।
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক, শিল্পী তরুণ ঘোষ।
চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম বলেন, কারুপণ্যের তৈরি বিভিন্ন পণ্য দেখে আমি ভীষণভাবে আপ্লুত। দেশ বিভাগের পর শতরঞ্জি একদম কমে গিয়েছিল। তরুণ প্রজন্ম বিদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে বিভিন্ন রকমের ফেলনা বস্তু কাজে লাগিয়ে অসাধারণ পণ্য নির্মাণ করছে। শতরঞ্জি দেশের বাজার ছাড়িয়ে বিশ্ববাজারে আরও বেশি ছড়িয়ে পড়বে-এটুকু বলতে পারি।
কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, বৃটিশরা আমাদের এই বাংলার যেসব সম্পদ নিয়ে গেছে, সেসব যে কতটা মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ-সেটা আমরা এখনও অনুধাবন করতে পারিনি। আমাদের দেশেরে ছেলেরা আমাদের পণ্যকে আরও বেশি করে বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে-এটা প্রত্যাশা করি।
এ সময় কবি তার নিজের একটি কবিতা পড়ে শোনান।
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, শতরঞ্জি মানেই শতেক রঙ। কারুপণ্য দীর্ঘদিন ধরে এই পণ্য নিয়ে কাজ করছে। এতে প্রায় ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কচুরিপানা, হোগলাপাতা, পাট দিয়ে বানানো এই শতরঞ্জিকে বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে রংপুরের মানুষ, কারপণ্যের কর্ণধার সফিকুল আলম সেলিম। তার পণ্যের এই জিআই প্রাপ্তিতে তাকে অভিনন্দন জানাই।
কারুপণ্যের উদ্যোক্তা সফিকুল আলম সেলিম বলেন, আমি নই আমরা সবাই মিলে কারপণ্যকে গড়ে তুলেছি। আজকের যা কিছু প্রাপ্তি, সব কারপণ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আমাদের এবং দেশের-জাতির প্রাপ্তি। বাংলাদেশে অনেক ক্ষুদ্র শিল্প রয়েছে, যার একটি আমাদের এই শতরঞ্জি। যে শতরঞ্জি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল-সেটাকে সরকার জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে। আমরা কেবল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছি। সবার কঠিন পরিশ্রম আর ভালোবাসার ফসলই হচ্ছে আজকের এই জিআই স্বীকৃতি।