চাঁপাইনবাবগঞ্জের দক্ষিণ পাঁকার এহসান আলী। ৫৫ বছরের জীবনে পদ্মার তীব্র ভাঙনের কারণে ছয়বার বাড়ি ভাঙতে হয়েছে তাকে। সপ্তম বারের মতো নদীর চরেই আবাসন গড়ার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। আগ্রসী পদ্মার তীব্র ভাঙন দেখেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন তাকে নতুন করে ঘর বানাতে গুণতে হবে লাখ টাকা।
এহসান বলেন, ‘সপ্তমবারের মতো এবার বাড়ি সরিয়ে নিচ্ছি। গত দু’বছর আগে নিশিপাড়া চর থেকে এখানে এসেছিলাম। এখন আবার রিশিপাড়া চরে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু সেখানে গিয়ে ঘর বানাবো কী করে? যতবার বাড়ি ভেঙেছি, ততোবারই কিস্তি (ঋণ) তুলে ঘর বাঁধতে হয়েছে। এবারও কিস্তি তুলতে হবে। আগের ঋণই তো শোধ করতে পারিনি। পাওনাদারকে দেব কি, নিজেই বা কি খাবো?’
সরজমিন ভাঙন কবলিত এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকার দশ রশিয়া থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের নারায়নপুর ইউনিয়নের বত্রিশ রশিয়া পর্যন্ত মোট সাড়ে ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পদ্মা নদীতে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। এসব এলাকায় অন্তত ৬০ হাজার মানুষের বসবাস। ইতোমধ্যে ঘরবাড়ি হারিয়েছে প্রায় হাজার তিনেক পরিবার। তাদের অধিকাংশ নিশিপাড়া চরে নতুন করে আবাসন গড়েছেন।
পদ্মা পাড়ের আরেক বাসিন্দা দুলাল। পৈত্রিক সূত্রে চার বিঘা আবাদি জমি পেয়েছিলেন। ওই জমিতে ধান, কলাই আর শীতকালিন সবজি চাষ করতেন তিনি। সবজি বিক্রির টাকাতেই চলতো সংসার। নদী ভাঙনে গত তিন বছরে সব শেষ। জীবন যুদ্ধ চালিয়ে নিতে তাই কিস্তিতে মুদিখানার দোকান দেন। দোকান থেকে যা আয় হয় তা থেকে পাওনাদারকে দেওয়ার পর আল্প টাকায় সংসার চালাতে হয় তাকে।
হতাশাভরা কণ্ঠে দুলাল বলেন, ‘দুবছর পূর্বে নিশিপাড়া চর থেকে দক্ষিন পাকায় এসে লোন তুলে বাড়ি আর দোকান ঘর তুলে ছিলাম। এরই মধ্যে ফের সব সরিয়ে নিতে হচ্ছে। নতুন জায়গায় ঘর তুলতে অন্তত এক লাখ টাকা লাগবে। সাত সদস্যের পরিবারক আমার। সবাইকে নিয়ে এক ঘরে থাকা যায় না। তাই বাধ্য হয়ে লোন তুলে বাড়ি করতে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘৩০-৩৫ শতাংশ হারে পাওনাদারকে সুদ দিতে হচ্ছে। নিজের নিদিষ্ট কোনো আয় রোজগারের পথ নেই। পরের জমিতে কৃষি কাজ করে কতোই বা আর আয় হয়। ধুকে ধুকে সংসার চালাতে হয়। সরকার যদি স্বল্পসুদে ঋণ দিতো, পদ্মা পাড়ের মানুষের তাহলে জীবনযাত্রা কিছুটা হলেও সহজ হতো। নতুবা এখানকার মানুষ মাথায় ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াবে।’
পদ্মা পাড়ের আরেক বাসিন্দা সাদ্দাম আলী বলেন, ‘চরাঞ্চলের মানুষ ঋণগ্রস্ত।সব হারিয়ে জীবনকে ফের সামনে এগিয়ে নিতে টাকার প্রয়োজন। অর্থের জোগান দিতে বাধ্য হয়েই ঋণ তুলতে হচ্ছে তাদের। এলাকার মানুষ রাজমিস্ত্রি, হরেকমাল বিক্রেতা, বর্গাচাষি, কেউ কেউ মুদি দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছে। এসব মানুষের আয়ের অধিকাংশ টাকা ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।’
দক্ষিণ পাঁকার মহল্লাদার জমসেদ আলী বলেন, ‘দশ রশিয়া থেকে বত্রিশ রশিয়া পর্যন্ত ৬০ থেকে ৬৫ হাজার মানুষের বসবাস। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে এসব এলাকার মানুষ ঋণগ্রস্ত। তিনবেলা খাওয়ার কথা ভুলে গেলেও পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করার কথা কেউেই ভোলেন না। বছরের পর বছর ধরে ঋণগ্রস্ত থাকে পদ্মা পাড়ের মানুষ।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘দশ রশিয়া থেকে বত্রিশ রশিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারের ভাঙনটা খুব তীব্র। ভাঙনরোধে ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে চর পাঁকার পয়েন্ট থেকে ৩৩০ টি জিও টিউব ও ১ হাজার জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হয়েছে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খান বলেন, ‘নদী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছি। পদ্মা পাড়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছি। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ৬০ জনের মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা করে মোট ৩ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। আরও বরাদ্দ আসলে ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে সেই অর্থ বিতরণ করা হবে।’