সারা বাংলা

ঠাকুরগাঁওয়ের সেই মন্দিরে ১৪৪ ধারা, ১৩ বছরে আসেনি সমাধান

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচাইতে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা ও ঢাক ঢোলের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন মন্দির ও মণ্ডপে চলছে এই মহোৎসব। তবে গত ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আউলিয়াপুরে অবস্থিত শত বছরের রশিক রায় জিউ মন্দিরের।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে মন্দিরের জমির দখল নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলছে। ২০০৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রশিক রায় জিউ মন্দিরে দুর্গাপূজা নিয়ে ইসকনপন্থী একটি পক্ষ ও অপর একটি পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সে সময় ইসকনভক্তদের হামলায় মন্দিরের সেবায়েত ফুলবাবু নিহত হন। সেই থেকে ওই মন্দিরে দুর্গাপূজার সময় স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে আসছে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। যথারীতি ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। তাই ইচ্ছা থাকলেও ২০০৯ সালের পর এই মন্দিরে দুর্গাপূজার আয়োজন করতে পারেননি স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

স্থানীয় বাসিন্দা মধুকান্ত বলেন, ‘আমার বাপ দাদারা এই মন্দিরেই পূজা আর্চনা করে এসেছেন। ছোটো থেকে আমরা ধুমধাম করে এই মন্দিরে দুর্গাপূজা পালন করেছি। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে এই মন্দিরে দুর্গাপূজার সেই আয়োজন এখন আর নেই। দ্রুতই সব সমস্যার সমাধান করে পূজার সুযোগ চাই আমরা।’  

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু তাহের মো. সামসুজ্জামান বলেন, ‘মন্দিরের জমি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। বিরোধের জেরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। এবছর দুর্গাপূজা ঘিরে সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। তাই  দুর্গাপূজা শুরুর আগের দিন (৩০ সেপ্টেম্বর) থেকে পূজা শেষর দিন (৬ অক্টোবর) পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারির আদেশ দেওয়া হয়েছে। পূজা শেষ হলে ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়ার চিন্তা আছে।’

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার ঘোষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার জন্য দুই পক্ষের সঙ্গে একাধিকবার বসার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনো পক্ষই বসতে আগ্রহী হয়নি। এরপরও বিষয়টি নিষ্পত্তির ব্যাপারে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘মন্দিরে ১৪৪ ধারা জারি করার পর থেকে সেখানে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১০০ বছর আগে জমিদার বর্ধামণি চৌধুরানী সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের মাদারগঞ্জ ও ভাতগাঁও মৌজায় শ্রীশ্রী রশিক রায় জিউ মন্দিরটি নির্মাণ করেন। মন্দির পরিচালনার জন্য তিনি ৮১ একর সম্পত্তি দান করেন। এরপর থেকে ওই মন্দিরে পূজা করে আসছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। ২০০৯ সালের দিকে মন্দিরের আয়-ব্যয় নিয়ে সেবায়েত ফুলেন চন্দ্র রায়ের সঙ্গে গ্রামবাসীর ভুল বোঝাবুঝি হয়। সেই থেকে ওই গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন।

ইসকনপন্থীরা জানান, ২০০১ সালে রশিক রায় জিউ মন্দিরের ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে তাদের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, মন্দির প্রাঙ্গণে ইসকন তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। পরে ইসকনবিরোধী সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যারা দীর্ঘদিন ধরে মন্দিরের সম্পত্তি ভোগ করে আসছিলেন, তারা চুক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন। কিন্তু চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ২০০৮ ও ২০০৯ সালে ইসকনের পক্ষে রায় দেন। ফলে শ্রীশ্রী রশিক রায় জিউ মন্দিরে ইসকন ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার আইনী অধিকার পায়।

২০০৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জন্মাষ্টমী উদযাপন নিয়ে এক সভায় মন্দিরের দায়িত্ব পূজা উদযাপন কমিটি চায়। কিন্তু ইসকন তা দিতে রাজি হয়নি। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে পূজা উদযাপন পরিষদের সঙ্গে ইসকনভক্তদের উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে। ১৮ সেপ্টেম্বর সকালে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে পূজা উদযাপন পরিষদের ফুল বাবু গুরুতর আহত হন। তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় তখন ইসকনের বর্তমান মহারাজসহ ৬২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। ওই মামলা এখনো বিচারাধীন। ওই সংঘর্ষের পরেই প্রশাসন মন্দিরের কর্তৃত্ব নেয়। বর্তমানে মন্দিরটি প্রশাসনের হেফাজতে রয়েছে। প্রশাসন সেই থেকে মন্দিরের সীমানার ভেতর দুর্গাপূজা উদযাপনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে।