গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ছোট একটি নৌকায় করে ১৫-২০ জন প্রথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খরস্রোতা ওয়াপদার কাটাখালের পশ্চিম পাড় থেকে পূর্ব পাড়ে যাচ্ছে। নৌকার মাঝি শৈলেন গাইন (৫৫) স্রোতের কারণে ঠিকভাবে নৌকার বৈঠা চালাতে পারছেন না। খালে পশ্চিম পাড় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের পারাপার দেখেছেন ফ্রান্সিস বৌদ্ধ। কিছু সময় পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে খালের পাড়েই বসে পড়লেন তিনি।
সরেজিমনে গিয়ে জানা গেছে, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীল ইউনিয়নের মুশুরিয়া গ্রামকে দু’ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে পয়সাটহাট-মোস্তাপুরের ওয়াপদার কাটাখাল। এ খাল পাড়ি দিয়ে মুশুরিয়া, চলবল, উত্তর চলবল, শৈলদাহ, নবগ্রাম, উত্তর রামশীল, ভাটেরবাড়ি, কাফুলাবাড়ি, জহরকান্দি ও ভূতেরবাড়িসহ অন্তত ১০টি গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ যাতায়েত করেন।
এই খালের পূর্বপাশে শৈলদাহ মুশুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এজি মিশন স্কুল, এসডিএ চার্চ স্কুল এবং পশ্চিম পাশে বিতান শিশু নিকেতন, মধ্য ও দক্ষিণ বাংলাদেশ শিশু উন্নয়ন প্রকল্প নামের মোট ছয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া পূর্ব পাশের বাসিন্দারে পশ্চিম পাশে ২০০ একর এবং পশ্চিম পাশের বাসিন্দাদের পূর্ব পাশে ৩০০ একর জমি রয়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষকে তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকা দিয়ে খালটি পারাপার হতে হয়। এছাড়াও প্রতিদিন এ খাল পাড়ি দিয়ে রোগী আনা-নেওয়াসহ কৃষি জমি, মাছের ঘের, হাট-বাজার ও ধর্মীয় উপসানালয়ে য়েতে হয় গ্রামবাসীদের।
খালের পাড়ে নৌকার অপেক্ষায় শিক্ষার্থীরা
এ খালের পীড়ারবাড়ী ও রামশীল এলাকায় সেতু থাকলেও মাঝখানের আট কিলোমিটারের মধ্যে নেই কোনো সেতু। স্বাস্থ্য সেবা নিতে প্রতিদিন ২০০ লোক এ খাল পার হয়ে আসেন। পশ্চিম পাশ থেকে সপ্তাহে দু’দিন হাট-বাজারের জন্য পূর্ব পাশে যেতে হয় ওই সব গ্রামের বসিন্দাদের।
ইতোপূর্বে এ খালে নৌকা ডুবির ঘটনায় দ্বিতীয় শ্রেণীর দুই শিক্ষার্থী মারা যায়। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়েও নানা দুঃচিন্তায় থাকতে হয় অভিভাবকদের। এমনকি ভরা বর্ষায় খড়স্রোতা এ খাল পাড়ি দিয়ে কৃষিপণ্য আনা নেওয়ায় দুর্ভোগে পড়তে হয়ে এলাকার কৃষকদের। সেতু না থাকার ফলে প্রায় আট কিলোমিটার ঘুরে ওই সব জমির ফসল ঘরে তুলতে হয় কৃষকদের। এতে খরচ ও সময় দুইটাই নষ্ট হচ্ছে।
এই খালে সন্তান হারানো ফ্রান্সিস বৌদ্ধ বলেন, ছোট শিক্ষার্থীরা যখন বিদ্যালয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নৌকা পারপার হয় তাদের মাঝেই আমি আমার মেয়েকে খুঁজে পাই। আমার মত অন্য কোনো বাবা যেন সন্তানেকে আর না হরায়। এমন কষ্টের বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকতে না হয় এমনটাই প্রত্যাশা। আমি এই খালের উপর ব্রিজ করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
মুশুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা অনিমেষ মধু বলেন, খাল পার হয়ে ১০ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ যাতায়াত করেন। প্রতিনিয়ত ঘটছে নৌকা ডুবির ঘটনা। আমার সন্তানকে এই খাল পার হয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। অনেক চিন্তায় থাকি। এই খালে প্রচুর স্রোত থাকায় গত সপ্তাহে খাল পারাপার হতে গিয়ে নৌকা ডুবে দশ জন শিক্ষার্থী তাদের স্কুলব্যাগ ও বই হরিয়েছে। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো এই খালের ওপর একটা সেতু নির্মাণের। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখনো সুদৃষ্টি দেননি।
রামশীল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী পূর্ণিমা বাড়ৈ বলেন, নৌকার পার হতে অনেক ভয় লাগে, অনেক সময় নৌকা ওপাড়ে থাকলে ১০ থেকে ২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। এতে সময় মতো আমরা কলেজে পৌঁছাতে পারি না।
উত্তর রামশীল গ্রামের বাসিন্দা মিলন বিশ্বাস বলেন, ‘খালের ওই পাড়ে আমার জমি। ফসল আনতে আমাদের ৮ কিলোমিটার ঘুরে রামশীল সেতু পার হয়ে জমিতে যেতে হয়। এতে আমাদের অনেক খরচ ও সময় ব্যয় হয়। আমারা প্রধানমন্ত্রীর আসনের মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি মুশুরিয়া গ্রামে একটি সেতু নির্মাণ করে যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধা করে দেওয়ার।
কোটালীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, রামশীলের মুশুরিয়ার শিক্ষার্থীসহ এলাকার লোকের যাতায়েতের অসুবিধার কথা জেনেছি। আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষে সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেবো।আশা করি দ্রুত এ বিষয়টির সমাধান হবে।