সারা বাংলা

এক ইউপিতে ২৮টি ইট ভাটা, এক ওয়ার্ডেই ১৪

নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার একটি ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে ২৮টি অবৈধ ইট ভাটা। এরমধ্যে ওই ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ডেই রয়েছে ১৪টি ভাটা। আর এসব ভাটার অধিকাংশরই নেই পরিবেশ ছাড়পত্রসহ অন্য বৈধ কাগজপত্র। 

চররমিজ ইউনিয়ন ইট ভাটাগুলোতে উঁচু চিমনি ব্যবহার করা হলেও কয়লার পরিবর্তে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ভাটাগুলোর বেপরোয়া ট্রাক্টরের কারণে অচল হয়ে পড়েছে চলাচলের রাস্তাঘাটও। এতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে একটি ওয়ার্ডের ১৫ হাজার বাসিন্দাকে। এদিকে জমির উপরি ভাগের উর্বর মাটি ভাটার কাজে ব্যবহার করায় ব্যাহত হচ্ছে ফসল উৎপাদন। হুমকিতে রয়েছে পরিবেশ ও জনজীবন। 

এদিকে গত ১০ দিনে এসব ইটভাটার ৮টিতে অভিযান চালিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। প্রত্যেক ভাটাকে এক লাখ টাকা করে ৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এসময় এসব ভাটাগুলোর চিমনী উপড়ে ফেলাসহ ফায়ার সার্ভিস দ্বারা চুল্লির আগুন নিভিয়ে দেওয়া হয় বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম শান্তনু চৌধুরী।

সরেজমিনে ইউনিয়নের আজাদ মেমোরিয়াল সড়ক ও সৈয়দ মৌলভি চৌধুরীর হাট সড়কের দুটি ইট ভাটায় গিয়ে দেখা যায়, ইট পোড়ানের জন্য ভাটাগুলো তৈরি করা হচ্ছে। কয়েকশ মণ কাঠ (লাকড়ি) ভাটা এলাকা স্তূপ করা রয়েছে। কয়েকজন শ্রমিককে দেখা যায়, স্তূপ থেকে মাটি কেটে পানি দিয়ে তৈরি করে নিচ্ছেন। আর অন্যরা ইট তৈরির কাজে ব্যস্ত। 

ভাটাগুলোতে ইট শুকানোর শ্রমিক হিসেবে  কাজ করতে দেখা গেছে শিশু শ্রমিকদের। প্রতিদিন ১০০ টাকা বেতনে শিশুরা ইটগুলো শুকানোর কাজ নিয়েছে। 

কেউ কেউ মৌসুম অনুযায়ী নির্দিষ্ট একটি বেতন নিয়ে কাজে নেমেছেন। নভেম্বর থেকে পুরো শুষ্ক মৌসুম জুড়ে ইটভাটায় কর্মযজ্ঞ চলে। এই ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড চর আফজাল গ্রামের ১৪ টি ইটভাটার মধ্যে রফিক ব্রিকস ও আশরাফ ব্রিকসের স্বত্ত্বাধিকারীরাই জানিয়েছে, তাদের ভাটাগুলোর বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। অভিযোগ রয়েছে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রাহিদ হোসেনসহ কয়েকজন মালেকদের কাছ থেকে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে ইটভাটাগুলো গড়ে উঠান। তাদের যোগসাজসেই ভাটাগুলো চালানো হয়।

রফিক ব্রিকসের স্বত্ত্বাধিকারী রফিক উল্যার ছেলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘কয়লার পরিবর্তে ভাটাতে কাঠ পোড়ানোর কারণে গেল বছর পরিবেশ অধিদপ্তর ২ লাখ টাকা আমাদের জরিমানা করেছে। পরে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড় পত্রের জন্য আবেদন করি আমরা। এখন পর্যন্ত অনুমোদন পাইনি।’ 

তিনি দাবি করে বলেন, ‘প্রশাসন যদি অন্য ২৭টি ভাটা বন্ধ করে তাহলে তিনিও নিজের ইটের ভাটা বন্ধ করে দেবেন। এবার আমার ভাটায় ৫০ লাখ ইট তৈরি হবে।’ 

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক তিনটি ইটভাটা মালিক বলেন, আমাদের ভাটারও বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আমাদের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। এরপরও আমরা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ভাটা তৈরি করেছি। 

আশরাফ ব্রিকসের স্বত্ত্বাধিকারী মো. আশরাফ গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতে রাজি হননি। তবে তিনি জানিয়েছেন , ইউনিয়নের অন্য ২৭টি ইটভাটার মতো তারটিও চলছে। ভাটা চালাতে তার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। অন্য কোন বৈধ কাগজপত্রও নেই।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেম নিজাম বলেন, ‘প্রতিটি ইটভাটায় অন্তত ২০ একর জমি প্রয়োজন হয়। এতে ১৪ টি ইটভাটা একটি ওয়ার্ডের অধিকাংশ জমি দখল করে আছে। এতে ভাটার ধোঁয়ার কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত হাজার হাজার টন কার্বনডাই অক্সাইড গিলে খাচ্ছে। মানুষের শ্বাসতন্ত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’  

২৮ ইটভাটার কথা স্বীকার করে চররমিজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজাহিদুল ইসলাম দিদার বলেন, ‘ভাটার বিরুদ্ধে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। সম্প্রতি ৮টি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়। ইটভাটার কারণে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ নানাভাবে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।’

উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ উঠেছে তবে এগুলো সত্য নয়। ভাটার মালিকরা কেন আমাকে টাকা দিতে যাবেন? চররমিজ ছাড়াও অন্যান্য ইউনিয়নেও অনেকগুলো অবৈধ ইটভাটা রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে নানা সময়ে জরিমানা ও ইটভাটা গুড়িয়ে দিচ্ছেন। এরপরও ফের ভাটা মালিকরা ইট পোড়াতে শুরু করেন। পরিবেশ অধিদপ্তর ভাটাগুলো বন্ধ করতে পারে।’

লক্ষ্মীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক হারুন অর রশিদ পাঠান বলেন, ‘সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর জেলায় আমরা দায়িত্ব পেয়েছি। এরমধ্যেই আমরা কয়েকটি ইটভাটায় গিয়ে অভিযান চালিয়েছি। জরিমানাও করা হয়েছে। ইটভাটা গুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করে তা প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হবে। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত দিলে আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেবো। আমাদের অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।’

এ ব্যাপারে রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসএম শান্তনু চৌধুরী বলেন, ‘জেলা প্রশাসন থেকে নির্দেশনা রয়েছে অবৈধ ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ৭ নভেম্বর থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। গেল ১০ দিনে আলাউদ্দিন ব্রিকফিল্ড, গিয়াস উদ্দিন ব্রিক্স, রফিক ব্রিক্স, এমএস ব্রিক্স, তিশা ব্রিক্স, আমরি ব্রিক্স, ফাতেমা নাজ আফরা ব্রিক্স ও ফারদিন আনাম ব্রিক্স নামের ৮টি ইটভাটায় অভিযান চালানো হয়েছে। এসব ভাটাকে এক লাখ করে ৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যহত থাকবে।‘

তিনি আরও বলেন, ‘উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বা অন্য কেউ ভাটা মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা নেয় কিনা তা আমার জানা নেই। কেউ আমার কাছে কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ ফেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’