এক মণ পলিথিন পুড়িয়ে ২০ কেজি ডিজেল, সাড়ে পাঁচ কেজি পেট্রোল ও আড়াই কেজি অকটেন উৎপাদন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন মোহাম্মদ ইউসুফ। পরিত্যক্ত পলিথিন পুড়িয়ে জ্বালানি তেল উৎপাদনের ব্যতিক্রমী এ উদ্ভাবন খুলনার কয়রা উপজেলার দেয়াড়া গ্রামে।
এছাড়া পলিথিনের ছাই দিয়ে মেসিনারিজ এ ব্যবহৃত গিরিজ ও ফটোকপি মেশিনের কালি তৈরির গবেষণাও চলাচ্ছেন ইউসুফ।
উদ্ভাবক ইউসুফ বলেন, ‘আমি ইউটিউবের মাধ্যমে জানতে পারি পলিথিন পুড়িয়ে জ্বালানি তেল উৎপাদন করা যাই। মেশিন তৈরি সম্পর্কে চায়নাদের বেশ কিছু ভিডিও দেখি। পরবর্তীতে আরও খোঁজ খবর নিয়ে চলতি বছরের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে বাড়িতে মেশিন তৈরি করে পরিক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করি। তেল পেয়ে নিজের মোটরসাইকেল ও শ্যালো মেশিনে ব্যবহার করি। সফল হওয়ায় পরে প্রায় দু’ লাখ টাকা খরচ করে আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনে একবারে ১৪/১৫ লিটার তেল উৎপাদনকারী একটি মেশিন তৈরি করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক মণ পলিথিন দিয়ে ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেন মিলে ২৮/২৯ লিটার তেল উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি জ্বালানি গ্যাসও উৎপাদন হচ্ছে। তবে জ্বালানি গ্যাস এখনও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারিনি। পরবর্তীতে জ্বালানি গ্যাস ও ফটোকপি মেশিনের কালি এবং গিরিস তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।’
সরেজমিন দেখা যায়, বড় টিনের ড্রামে পলিথিন ভরে মুখ বন্ধ করে আগুনের তাপ দেওয়া হচ্ছে। তাপে ড্রামের সঙ্গে লাগানো পাইপ দিয়ে বেরিয়ে আসা ধোঁয়া (বাষ্পীয় পদার্থ) পানিভর্তি একটি ছোট ড্রামের মধ্য দিয়ে কিছুটা শীতল হয়ে পাইপের সাহায্যে তরল আকারে তিনটি পাত্রে জমা হচ্ছে। আর বাকি ধোঁয়া অন্য একটি পাইপের মাধ্যমে টিনের ড্রামের তলে আগুন জ্বলছে। ফলে পলিথিন পোড়াতে তার বাড়তি তেমন কোন জ্বালানি লাগছে না। প্রথমে কাঠ দিয়ে সামান্য কিছুক্ষণ জ্বালানোর পরে বাকি সময় উৎপাদিত গ্যাস দিয়ে তাপ দিতে দেখা গেছে।
মূলত প্রথমে তাপের মাধ্যমে বাষ্প তৈরি, আর বাষ্প পানির মাধ্যমে শীতল করে তরল পদার্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। পরে ওই তরল পদার্থ রিফাইন মেশিনের মাধ্যমে তিনটি আলাদা আলাদা পাত্রে অকটেন, পেট্রোল ও ডিজেল আকারে বেরিয়ে আসতে দেখা গেছে।
ইউসুফ বলেন, ‘এখন প্রতি সপ্তাহে দু’বার উৎপাদন করছি জ্বালানি তেল। উৎপাদিত অকটেন ও পেট্রোল বিক্রি আর ডিজেল নিজের শ্যালো মেশিনে ব্যবহার করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পলিথিন পোড়ানোর সময় ধোঁয়া ড্রাম থেকে বাইরে বের হতে পারে না। এই ধোঁয়া (বাষ্প) তরল করে রিফাইনের মাধ্যমে তেল উৎপাদন করছি। এজন্য পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার কোনো শঙ্কা নেই। বরং একদিকে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা পরিত্যক্ত পলিথিনের ক্ষতি থেকে প্রকৃতি যেমন রক্ষা পাচ্ছে, তেমনি দেশে চলমান জ্বালানি তেলের সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখবে এই তেল।’
নতুন এ জ্বালানি উদ্ভাবনের বিষয়ে স্থানীয় শিমলারআইট গ্রামের আজিজুল গাজী বলেন, ‘বিষয়টি শোনার পরে বিশ্বাস করতে পারিনি। তবে নিজের চোখে দেখে আমি অবাক হয়েছি।’
আমিরুল ইসলাম গাজী, রাকিব, সেলিম নামে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ‘এখানে উৎপাদিত জ্বালানি তেল দিয়ে মোটরসাইকেল ভালোভাবে চলছে। একদিকে সামান্য হলেও জ্বালানি তেলের চাহিদা মিটছে।’
স্থানীয় বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম ফকির বলেন, ‘ইউসুফ দারিদ্রতার কারণে তেমন লেখাপড়া করতে পারেননি। তবে ছোটবেলা থেকে গবেষণা করে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করেছেন। চীন দেশের মেশিন ইউটিউবে দেখে নিজ বাড়িতে সব তৈরি করেছেন। এটা আমাদের গর্বের বিষয়।’
ইউপি সদস্য আব্দুল মান্নান বলেন, ‘ইউসুফের প্রযুক্তিগত মেধা খুব প্রখর। আমাদের প্রত্যন্ত এলাকায় জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে এটা সত্যি প্রশংসনীয়। আর্থিক সহযোগীতা পেলে তিনি ভালো কিছু করতে পারবেন। বড় পরিসরে এই কাজ করতে পারলে দেশের জ্বালানির চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বেকারদের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হবে।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ ইউসুফ আল হারুন বলেন, ‘পলিথিন পোড়ানোর পর সম্পূর্ণ ধোয়া রিসাইক্লিন করা হচ্ছে সেহেতু পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা নেই। এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। অবশ্যই পরিবেশ বান্ধব। পরিত্যক্ত পলিথিন পরিবেশের যে ক্ষতি করে সেটা থেকে আমরা রক্ষা পাবো।’
খুলনা বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন বলেন,‘যদি সঠিক পদ্ধতিতে এই কাজটি করা হয় তাহলে আমাদের জন্য ক্ষতিকর না। বিষয়টি দেখার জন্য কর্মকর্তাকে সরেজমিনে যেতে বলা হয়েছে। এর জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় করতে পারল এটি অবশ্যই আমাদের জন্য ভালো হবে। আর যদি এর পদ্ধতিটা সঠিক না হয়, তাহলে পরিবেশে দূষণ ছড়িয়ে পড়বে।’