সারা দেশ যখন মুক্তির আনন্দে ভাসছে খুলনার শিরোমণি রণাঙ্গনে তখনও মুক্তিবাহিনী প্রাণ বাজি রেখে লড়েছিল। ফলে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস হলেও খুলনায় বাঙালির বিজয়ের স্বাদ পেতে আরো একটি দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী খুলনার শিরোমণিতে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে ১৭ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিল।
আত্মসমর্পণকালে র্যাংক-ব্যাজ খোলার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা নাকি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকে, ‘ইয়া আল্লাহু মেরা ভাইকা সাথ ভাই লড়েগা তো দুষমণকা সাথ কোন লড়েগা।’
সব মিলিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি, সম্মুখ সমর, যুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য সব ধরণের কলা-কৌশলের প্রয়োগ শিরোমণির যুদ্ধকে ঐতিহাসিক মর্যাদা দিয়েছে। এ যুদ্ধের ইতিহাস বাংলাদেশ, ভারতের দেরাদুন (উত্তরখন্দ প্রদেশে) আর্মি একাডেমি, ব্রিটেনের স্যান্ড হার্স্ট আর্মি একাডেমিতে পাঠ্য হিসেবে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এ যুদ্ধের ঐতিহাসিক বর্ণনায় বিশিষ্ট লেখক গাজী সাইফুল হাসান তার ‘দ্য ট্যাংক ব্যাটল অব শিরোমণি’ বইয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। এছাড়া শিরোমণি ট্যাংক ব্যাটলে অংশগ্রহণকারী, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ খানজাহান আলী থানা শাখার আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা স.ম. রেজওয়ান আলীও করেছেন স্মৃতিচারণ।
শিরোমণি’র মূল যুদ্ধ পর্ব: খুলনার শিরোমণিতে প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে চলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিশাল যুদ্ধ প্রস্তুতি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য শিরোমণি ও এর আশেপাশে অবস্থান গ্রহণ করে। মিত্রবাহিনীও ছিল মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে প্রতিটি ধাপে। শিরোমণিতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয় ১৩ ডিসেম্বর (১২ ডিসেম্বর দিবাগত রাত থেকে)।
বীর মুক্তিযোদ্ধা স.ম. বাবর আলী তার স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান গ্রন্থে শিরোমণির যুদ্ধ বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘গোলাগুলিতে এলাকা কম্পিত হতে থাকে। মেজর মঞ্জুর শেখ, আলকাস আলী ও স.ম. রেজোয়ানের নিকট ইস্টার্ণ জুট মিল, আফিল জুট মিল, আলীম জুট মিল এবং ক্যাবল ফ্যাক্টরির ম্যাপে অবস্থান দেখিয়ে দিতে বলে। তারপর এসব পয়েন্টে শুরু করে ভারী মেশিনগানের গোলাবর্ষণ। মিত্রবাহিনী কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে বিমান হামলার ব্যবস্থা করে। এভাবে শিরোমণিতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে স্থল ও আকাশ পথে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালিত হয়। পাকবাহিনীর পক্ষ থেকে তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়, দিবারাত্র এ যুদ্ধ চলতে থাকে। মিত্রবাহিনীর বোমা আক্রমণে শিরোমণি অঞ্চল ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় এবং পাকসেনারা জান জীবনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। খানসেনাদের বহু ট্যাংক, জিপ ও গোলাবারুদের স্তুপ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় এবং পাকসেনারা কাবু হয়ে পড়ে।
দু'দিন ধরে শিরোমণি সংলগ্ন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় মিত্রবাহিনী মনে করে পাকিস্তানি বাহিনী হয়তো খুলনা শহরের দিকে অগ্রসর হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের বারবার নিষেধ সত্ত্বেও মিত্রবাহিনীর ২৮টি গাড়ির বহর মেজর মাহেন্দ্র সিং এবং মেজর গণির নেতৃত্বে খুলনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু শিরোমণি এলাকা পার হয়ে বাদাম তলায় গাড়ির বহর প্রবেশ করা মাত্রই অতর্কিত আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিত্রবাহিনীর ২৮টি গাড়ির মধ্যে ২৬টি গাড়ি ধ্বংস হয়। ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। এতে আনুমানিক ২৫০/৩০০ সৈন্য আহত ও নিহত হয়। মেজর গণিও নিহত হন এ হামলায়। কিন্তু মেজর মাহেন্দ্র সিং গাড়ি নিয়ে পালাতে সক্ষম হন।
শিরোমণির যুদ্ধ প্রসঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যুদ্ধ পরিস্থিতির সংবাদদাতা মুসা সাদিক তার ‘মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম' গ্রন্থে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করেন, ১৬ ডিসেম্বর রাত ৯টায় শিরোমণির মাটি গর্জে উঠলো। শীতের রাতের বাতাস বারুদে ভারি হয়ে উঠলো। মাটি কাঁপিয়ে গর গর করতে করতে পাঞ্জাবিদের ট্যাংক মঞ্জুরের মুক্তিযোদ্ধাদের দু'টি পজিশন নিমেষে গুড়িয়ে দিয়ে গেলো। চার পাশের আমকাঁঠালের গাছ নারিকেল ঘেরা ও অন্যান্য গাছগুলোর ডালপালা কামানের গোলায় ভেঙে ভেঙে পড়তে লাগলো। কামানের শব্দে, ট্যাংকের গর্জন ও আহতদের আর্তনাদে শিরোমণি সেদিন তড়পাতে লাগলো। কামানের গোলা, ট্যাংকের গর্জন আর মর্টার শেলিং-এ তেতে, পুড়ে, ফেড়ে ফেড়ে যাচ্ছিল শিরোমণির জমিন। গোলার আগুনে ঝলসে ওঠে আকাশ। ভূমিকম্পের মত কেঁপে কেঁপে ওঠে খুলনার আকাশ। অবিরাম যুদ্ধ চলছে। কোনো পক্ষই বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়। যুদ্ধের তীব্রতা ক্রমেই বাড়তে শুরু করে।
মুসা সাদিকের ভাষায়- এক মিনিট এক মিনিট করে প্রচুর রক্ত ঝরলো শিরোমণির বুকে। অনেক মৃত্যু। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা বিরামহীন সংঘর্ষ এগিয়ে চললো। অষ্টম সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা বাংকারে বাংকারে আহত হচ্ছে। সাথীরা বাংকারের মধ্যে বসে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছে আর আহত অবস্থায় বাংকারে দাড়িয়ে থ্রি নট থ্রি, এসএলআর-এর ট্রিগার সমান গতিতে চেপে যাচ্ছে। দূর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নিয়ে আসছে এক মগ পানি কেউ অগ্রবর্তী কোনো ট্রেঞ্চে যুদ্ধরত সঙ্গীদের জন্য। বিরাম নেই কারো, নেই কোনো দিকে চোখ ফেরানোর অবকাশ। সব চোখ সামনে, শত্রুর নিশানে, হানাদার বাংকারে। এইভাবে চললো সেই মরণযুদ্ধ শিরোমণির বুকে।
অবিরাম চলমান যুদ্ধের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য আকাশ থেকে লিফলেট ফেলা হয়। কিন্তু আত্মসমর্পণের কোনো নিশানা শত্রুপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে সময় গড়াতে থাকে।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ড ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও শিরোমণিতে যুদ্ধ চলছে। ১৬ ডিসেম্বর রাতে শিরোমণিতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সার্বিক যুদ্ধ কৌশল, যুদ্ধ পরিস্থিতি ও সাংগঠনিক শক্তি বিবেচনা করে মুক্তিযুদ্ধকালীন ৮ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর শিরোমণিতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পরবর্তী অপারেশনের জন্য সার্বিক নেতৃত্ব প্রাপ্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। মেজর মঞ্জুর সে ক্ষমতা পেয়েছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর রাত ৪ টার দিকে মেজর মঞ্জুর সব ফোর্স সদস্যকে সঙ্গী করে নতুন রণকৌশলে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।
মেজর মঞ্জুরের নতুন সজ্জিত রণকৌশল সম্পর্কে মুসা সাদিক তাঁর 'মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম' গ্রন্থে বলেন, শিরোমণির ডাইনের এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) কলামটাকে ফ্রন্ট লাইনের পেছনে সেকেন্ড ডিফেন্স এ আনেন। কামান্ড দেন মেজর হুদাকে। ফ্রন্ট লাইনের এ্যালাইড ফোর্সকে শিরোমণির ডাইনের ডিফেন্সে পাঠান। বাম দিকের দু'টি ও পেছনের কমান্ডো কলাম তিনটিকে ফ্রন্ট লাইনের ডিফেন্স-এ বসান। ডানে পেছনে সে স্থানে চলে যায় এ্যালাইড ফোর্স। মেইন রোডের নিচে ঘাপটি মেরে বসে থাকা মিত্রবাহিনীর ট্যাংকগুলোর দু'টিকে সংকেত অনুযায়ী শিরোমণি খুলনার মেইন রোডে ও অন্য ছ'টিকে ডান দিকের নিচু বেত গাছের পাশ দিয়ে হেভি ক্যাজুয়ালটি মেনে নিয়েও দুর্ভেদ্য পাক ডিফেন্সের পেছনে জুড়ে দেন শহীদ হতে প্রস্তুত ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডোকে।
সামনে পঁচিশটিরও বেশি পাকিস্তানি ট্যাংক দেড় শতাধিক কামান, কয়েকশ মর্টার। প্রতি সেকেন্ডে উদগীরণ করে চলেছে হাজার হাজার গোলা, সীসা ও বারুদের দলা। চারিদিকে সেই কামানের গোলা, বারুদের গোলা আর ট্যাংকের গর্জনের মধ্য দিয়ে এসএলআর উচিয়ে হাত সবার আগে উঁচু হয়ে ছুটছে কমান্ডো মেজর মঞ্জুর। তাকে জড়িয়ে ছুটছে তার স্যুইসাইডাল ঝটিকা কমান্ডোরা। তাদের সামনে পড়েছে কামানের গোলা, পেছনে পড়ছে স্পিলিন্টার ওপরে পড়ছে ঝলকানো বারুদের দলা। একে বেকে, কাত হয়ে, গড়িয়ে, লাফিয়ে একটা গোলাকার মাংসপিণ্ডের মতো হয়ে তার ঝটিকা কমান্ডোদের নিয়ে অর্ডার অনুযায়ী মিত্রবাহিনীর দুটি-১৬০ ট্যাংক মাটি কামড়ে ছুটলো তার সাথে সাথে ক্ষিপ্রগতিতে। ছুটলো আরো আটজন করে স্যুইসাইডাল কমান্ডো প্রতি ট্যাংকের গায়ে গা মিশিয়ে। ফ্রন্ট লাইনের কমান্ডো কলামটা ছুটে গেলো কমাণ্ডারের গতি পথের দিকে। ১৬ ডিসেম্বরের সেই ভোর সোয়া ৫টার দিকে শিরোমণির বুকে মঞ্জুর তার কমান্ডোদের নিয়ে পাকিস্তানি ব্যুহের মধ্যে ঢুকে যান।
চরম বিপর্যয় ও বিপদের এই মুহুর্তে মেজর হুদা সেকেন্ড লাইন তৎক্ষণাত ফ্রন্ট লাইন এগোতে বললেন। মিত্রবাহিনীর আর্টিলারীর ছত্রছায়ায় হানাদারের গোলাগুলি বৃষ্টির মধ্যে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র তুলে দৌড়ে গেল ফ্রন্ট লাইনের বাঙ্কারে, পজিশনে। ডানদিক থেকে ছুটে গেছে ট্যাংকসহ মিত্রবাহিনী। তিনমাইল জুড়ে দু'পক্ষের কামান ও ট্যাংকের গোলা বর্ষণে শিরোমণি তড়পাতে লাগলো। আশে পাশের গাছপালার ডাল, নারকেল গাছের মাথা ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। কামানের গোলা, ট্যাংকের গোলায় দিনের আলোর মতো ঝলসে ঝলসে উঠছে শিরোমণির আকাশ-জমিন। বাতাসের প্রতি পরমাণু বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে।
ততক্ষণে হায়াত খানের কামানের গোলা, ট্যাংকের গর্জন আর মর্টার শেলিং এর ব্যুহের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন মঞ্জুর তার স্যুইসাইডাল কমান্ডো স্কোয়াড নিয়ে। পাকিস্তানি কর্ণেল- ব্রিগেডিয়ারদের বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে না কাটাতে চোখের নিমিষে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল হায়াত খানের ডিফেন্স, দুর্ভেদ্য বাংকার ভেঙে ফেটে চৌচির। জ্বলন্ত ট্যাংক থেকে ভীত বিহ্বল সব হানাদাররা বেরিয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ছে। শিরোমণি পেছনে ফেলে হায়াত খানেরা পেছনে দৌঁড়াচ্ছে।
একজন কমান্ডো দৌঁড়ে এসে খবর পৌঁছে দেয় খানেরা ভেগে যাচ্ছে'। 'জয় বাংলা' বলে মুক্তিসেনারা দ্বিগুণ তেজে শত্রুদের ধাওয়া করে নিয়ে চলে। ভোর পৌনে ৬টায় এলো মিত্রবাহিনীর জঙ্গি বিমানের বহর। তুমুল বোমা বর্ষণ ও রকেট হামলায় হানাদার বাহিনীকে গুড়িয়ে পুড়িয়ে ফেলে।
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমৰ্পণ: ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান আনুমানিক ৩ হাজার ৭০০ পাকিস্তানি সৈনিকসহ শিরোমণিতে আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মেজর মঞ্জুর পাকিস্তানি বাহিনীর কর্মকর্তাদের র্যাংক ব্যাজ খুলে দিতে বললে তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তারা ক্ষোভ ও ক্রোধে চিৎকার করে বলতে থাকে ‘আমাদের হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কথা বলে এখানে নিয়ে এসেছে, কিন্তু আমরা এতদিন মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়েছি। তারা কাদতে কাদতে আরো বলে, ‘ইয়া আল্লাহু মেরা ভাইকো সাথ ভাই লড়েগা তো দুষমণকা সাথ কোন লড়েগা।’
পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের এ ধরণের অপপ্রলাপ বা বিবেচনাবোধ কোনো মতেই গ্রাহ্য নয়। তারা এদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার প্রতিরোধ এদেশের মুক্তিযোদ্ধারা ও সর্বস্তরের জনগণ সর্বশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের প্রতিটি সদস্যকে নতি স্বীকারে বাধ্য করেছিল।
শিরোমণি যুদ্ধের গুরুত্ব: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যুদ্ধ পরিস্থিতির সংবাদদাতা ছিলেন মুসা সাদিক। তিনি তার ‘মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম' গ্রন্থে শিরোমণির ট্যাংক ব্যাটেলকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সংগঠিত বিশ্ববিখ্যাত আল-আমিন ট্যাংক ব্যাটল এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। শিরোমণি ট্যাংক ব্যাটল এর নেতৃত্ব, যুদ্ধকৌশল, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের চরম সাহসিকতা আর বীরত্বগাঁথায় অনন্য ‘দ্য ট্যাংক ব্যাটল অব শিরোমণি।’ এ যুদ্ধের ইতিহাস বাংলাদেশ, ভারতের দেরাদুন (উত্তরখন্দ প্রদেশে) আর্মি একাডেমি, ব্রিটেনের স্যান্ড হার্স্ট আর্মি একাডেমিতে পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শিরোমণি যুদ্ধে একইসাথে ট্যাংক যুদ্ধ, আর্টিলারি যুদ্ধ, বেয়নেট যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধের সম্ভব্য সকল কৌশল দৃষ্ট হয় শিরোমণি যুদ্ধে। সঙ্গতকারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক বিশেষ মর্যাদা লাভ করে শিরোমণি যুদ্ধ।
শিরোমণি যুদ্ধের ভয়াবহতা ছিল প্রকট। ১৭ ডিসেম্বর যুদ্ধের দামামা থেমে গেলেও শিরোমণির বুকে দীর্ঘ দিনব্যাপী যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন অক্ষত ছিল। শিরোমণি এলাকায় যুদ্ধকালীন ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পাকা দালান বাড়ি, বৃক্ষ এবং ইলেকট্রিক খুঁটি যুদ্ধের একযুগ পরেও স্থানীয় বসবাসকারীদের যুদ্ধ স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল।
ট্যাংক যুদ্ধ মোকাবেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার পরিচয় ফুটে ওঠে মাহবুব-উল-আলম এর একটি গ্রন্থে। তিনি গ্রন্থটিতে ট্যাংকের বিরুদ্ধে মানুষ জিতেছে শিরোনামে কয়েকটি লাইন লেখেন, ‘একদিকে ট্যাংক, অন্য দিকে গ্রেনেড হাতে মানুষ। টাইগাররা দেখিয়ে দিল যে এই অসমান মোকাবিলায়ও মানুষ জিততে পারে।... এদের প্রত্যেকেই পরিচয় পেয়েছে বঙ্গশার্দুলের প্রকাণ্ড থাবার ‘দ্য ট্যাংক ব্যাটল অব শিরোমণি’।
স্মৃতিস্তম্ভ: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠিত যুদ্ধের মধ্যে প্রায় ২০০টি যুদ্ধকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। এসব যুদ্ধের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে সরকার সংশ্লিষ্ট যুদ্ধ স্থানকে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। শিরোমণির যুদ্ধটিও সরকারের করা তালিকায় স্থান পেয়েছে এবং ইতোমধ্যে সরকার শিরোমণি সংলগ্ন গিলাতলাতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেছে।
তবে যুদ্ধের মূল স্পট শিরোমনিতে এখনও নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। সেখানে শুধুমাত্র একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে।
শিরোমণি ট্যাংক ব্যাটলে অংশগ্রহণকারী ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ খানজাহান আলী থানা শাখার আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা স.ম. রেজওয়ান আলী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন বাঙালি জাতির জন্য ঐতিহাসিক ও গর্বিত এক অর্জন। তাই বর্তমান প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। শিরোমণি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অনস্বীকার্য। শিরোমণি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করতে অবদান রাখতে পেরে নিজেকে সব সময়ই ধন্য মনে করি।’
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘মূলযুদ্ধ ও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়েছিল শিরোমণিতে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছরেও সেখানে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হয়নি। স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধক্ষেত্র শিরোমণিতেই একটা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক, যা আগামী প্রজন্মের জন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে। এটাই এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধা তথা স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রাণের দাবি।