উত্তরের নদীবেষ্টিত দুই জেলা গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম। নদীর এপারে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা, ওপারে কুড়িগ্রামের চিলমারী। দুই জেলার মাঝপথ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে দেড় কিলোমিটার প্রসস্ত তিস্তা নদী। এই দুই উপজেলার লাখ লাখ মানুষের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যমে ছিলো খেয়া পারাপার।
দিনে খেয়াতে নদী পাড়ি দিতে পারলেও সন্ধ্যা নেমে এলেই বন্ধ হয়ে যায় খেয়া পারাপার। দূরত্ব মাত্র দেড় কিলোমিটার হলেও দেরি কিংবা যে কোনো কারণে খেয়া ধরতে না পারলে উপোষ করে রাত কাটাতে হয় নদী পাড়ি দিতে না পারা অপেক্ষারত মানুষদের।
যুগযুগ ধরে যাতায়াতের সেই দুর্ভোগ নিরসনে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে নির্মিত হচ্ছে ১ দশমিক ৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের স্বপ্নের তিস্তা সেতু। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কুড়িগ্রাম, উলিপুর, নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী, চিলমারী থেকে সড়কপথে ঢাকার দূরত্ব কমে আসবে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। দূরত্ব কমবে বিভাগীয় শহর রংপুরেরও। এতে বাঁচবে সময় ও অর্থ। পাল্টে যাবে উত্তরের এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের ধারা, ঘুচবে দুঃখ এবং ঘটবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাইবান্ধা জেলা শহরের শাহ আবদুল হামিদ স্টেডিয়ামে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে হরিপুর ঘাটে তিস্তা নদীর উপর সেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন এ সেতুটির নির্মাণের দায়িত্ব পায় চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন। আর এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে। সময়সূচি অনুযায়ী ২০২৩ সালে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা।
ভূমি অধিগ্রহণ, মূল সেতু, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, সম্প্রসারণ এবং নদী শাসনসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন খরচ বাবদ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ২৯০টি পাইল, ১৫৫টি গার্ডার, ৩০টি পিলার, ২৮টি স্প্যান, সেতুর দুই পাশে ১ কিলোমিটার করে সংযোগ সড়ক এবং দেড় কিলোমিটার করে নদী শাসনের মাধ্যমে সেতুটির পূর্ণাঙ্গরূপ দিতে ব্যয় হচ্ছে ৩৬৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় ১৩৩ একর।
সেতুটির দক্ষিণ প্রান্তের সুন্দরগঞ্জ অংশের ২ কিলোমিটার সড়কসহ চিলমারী-ধর্মপুর-মন্ডলের হাট-লক্ষীপুর-সাদুল্লাপুরের ধাপের হাট (ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক) পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় ৮৬ কিলোমিটার সড়কপথ। এরমধ্যে ৫০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ বাস্তবায়ন করছে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা। বাকি ৩৬ কিলোমিটার সড়কের কাজ বাস্তবায়ন করছে যথাক্রমে গাইবান্ধা ও সাদুল্লাপুর এলজিইডি। দীর্ঘ এ সড়কে বন্যার পানি নিষ্কাশনের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে ১১-১২টি ব্রিজ এবং ৫৮টি বক্স কালভার্ট।
সরেজমিনে দেখা যায়, সেতুটির ২৯০টি পাইলের মধ্যে বসানো হয়েছে ১৭৫টি, গার্ডার ১৫৫টির মধ্যে বসানো হয়েছে ৭৪টি এবং ৩০টি পিলারের মধ্যে ইতোমধ্যেই কাজ সম্পন্ন হয়েছে ১৪টির। আর ৩০টি পিলারের ওপর স্প্যান বসানো হবে ২৮টি। তারমধ্যে স্প্যান বসানো সম্পন্ন হয়েছে ৮টি এবং আরো ২টি স্প্যান আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে সেতুর ওপর বসানো হবে বলে জানিয়েছে এলজিইডি।
২০২৩ সালের জুন নাগাদ সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে অবহেলিত এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য হবে সুপ্রসন্ন। যার ইতিবাচক ফল ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
এদিকে সেতু নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখতে প্রতিদিনই নদী পাড়ে ভিড় করছেন নানা বয়সের নারী-পুরুষরা। আর সেতুর উভয় দিকে এরই মধ্যে পসরা সাজিয়ে বসেছে ৪০-৫০টি হরেকরকম দোকান।
তিস্তাপারের বাসিন্দারা বলছেন, হরিপুর-চিলমারী তিস্তা সেতুর কাজ শেষ হলে এটি হবে উত্তরাঞ্চলের নদী তীরে মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। যাতায়াত ও কৃষিপণ্য পরিবহন সহজ হবে। নিশ্চিত হবে ফসলের ন্যায্য মূল্য। দুই পাশে নদী শাসন করায় কমবে তিস্তার ভাঙন। একই সঙ্গে নদীপারের হাজারও মানুষের ব্যবসার প্রসার ঘটবে। চিকিৎসা, শিক্ষাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি পাবে এই সেতুর মাধ্যমে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী মো. শামসুল আরেফিন খান বলেন, ‘সেতুটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে প্রায় ৪০ ভাগ। যেভাবে কাজ চলছে তাতে আশা করা যায় আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবে।’
গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাবিউল ইসলাম বলেন, ‘সেতুটির নির্মাণ কাজ পুরোদমে চলছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্মাণ কাজ শেষ হবে। নির্মাণ কাজ শেষে সেতুটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানের পুরো চিত্রই পাল্টে যাবে।’