বাংলাদেশের ঘড়ির কাঁটা সকাল ৯টা ছোঁয়ার আগেই স্টেডিয়ামের চারটি গেটে দর্শকদের জটলা। একটা বড় উপলক্ষে সাত সকালেই হাজির মিরপুর শের-ই-বাংলায়। ভারতকে টেস্টে হারানোর সুযোগ। ২২ বছরের লালিত স্বপ্ন!
সাদা পোশাকে দর্শকদের আগ্রহের কথা বলে আসছিলেন ক্রিকেটাররা। আজ মাঠে ঢুকে সেই সংশয় কেটে গেছে নিশ্চয়ই। সকাল সাড়ে নয়টায় প্রথম বল মাঠে গড়ানোর আগেই হাজার পাঁচেক দর্শক স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে। সময় যত গড়িয়েছে বেড়েছে সেই দর্শক। মাঠে বসে ভারতকে টেস্টে হারানোর স্বাদ তারা পেতে চেয়েছিলেন। টিভির সামনে বসে অপেক্ষায় ছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া।
কিন্তু ১১৭ মিনিটের রোমাঞ্চকর লড়াই শেষে স্বাগতিক শিবিরে বিষাদের সুর। ড্রেসিংরুমে কান পাতলেই শোনা যায় হাহাকার। অস্থির পায়চারিতে বোঝার উপায় নেই একটু আগেই কত বড় সুযোগটি হাতছাড়া করেছেন সাকিব, লিটন, মিরাজ, তাইজুলরা।
ম্যাচের চতুর্থ দিনেই বের হবে ফল, তা আগেই অনুমেয় ছিল। ১৪৫ রান তাড়ায় ভারতের প্রয়োজন ছিল ১০০ রান। বাংলাদেশ আগের দিন ৪ উইকেট তুলে কাজ এগিয়ে রেখেছিল। ইতিহাস গড়তে আজ দরকার ছিল ৬ উইকেট। শুরুর এক ঘণ্টায় মিরাজ, সাকিব যা করলেন তাতে রঙিন উৎসবের মঞ্চ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পরের ৫৭ মিনিটে যা হলো তা স্রেফ বিষাদে পরিণত হয়।
আগের দিনের অপরাজিত অক্ষর-উনাদকাটের জুটি ভেঙে যায় দ্বিতীয় ওভারে। অধিনায়ক সাকিব উনাদকাটকে এলবিডব্লিউ করে ব্রেক থ্রু এনে দেন। বাংলাদেশের ভয়ের কারণ ছিল রিশাভ পান্ত ও অক্ষল জুটি। কিন্তু মিরাজ প্রথম ঘণ্টার আগেই তুলে নেন এই দুই উইকেট। পান্তকে ফাঁদ পেতে এলবিডব্লিউ করার পর অক্ষরকে বোল্ড করেন। ১৮ রানে ৩ উইকেট তুলে জয়ের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছিল বাংলাদেশের আকাশে।
কিন্তু এরপর যা হলো তা ভেঙে দেয় বাংলাদেশের জয়ের স্বপ্ন। দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও শ্রেয়াস আইয়ার জিতিয়ে দেন ভারতকে। অশ্বিন যখন ব্যাটিংয়ে নামেন তখন ভারতের জয়ের জন্য দরকার ছিল ৭১ রান। সকালে খেলা শুরুর আগে একাডেমি মাঠে ঘণ্টাখানেক ব্যাটিং করে নিজেকে আগেই ঝালিয়ে নিয়েছিলেন অশ্বিন। মূল ২২ গজে সেই ছাপ পাওয়া গেলো স্পষ্টভাবে। কভার ড্রাইভ, পুল, স্কয়ার কাটে এক-দুইয়ের পাশাপাশি অনায়াসে বাউন্ডারি তুলে স্বাগতিক সমর্থকদের হৃদয় ভেঙে দিয়েছেন। সঙ্গে আইয়ারও এগিয়েছেন সিদ্ধহস্তে।
তবে একটি সুযোগ তৈরি করেছিলেন মিরাজ। ১ রানে তার বলে শর্ট লেগে ক্যাচ তুলেছিলেন অশ্বিন। মুমিনুলের হাতে রেগুলেশন ক্যাচই গিয়েছিল। ওই পজিশনে দাঁড়িয়ে এই টেস্টে পুজারা ও বিরাটের কঠিন ক্যাচ নিয়েছেন যিনি। কিন্তু অশ্বিনের ক্যাচটা তালুবন্দি করতে না পারায় বাংলাদেশের হাত থেকে ম্যাচটা ফসকে যায়। ওই ক্যাচ ছাড়ার পর শারীরিক ভাষায় কিছুটা আলগা মনোভাবও চলে আসে। যা বোলিংয়েও স্পষ্ট বোঝা যায়।
সাকিব, তাইজুল, মিরাজরা পরবর্তীতে আক্রমণে এলেও আগের ধার থাকেনি। তাসকিন এদিন বোলিংয়ের সুযোগ পাননি। খালেদ বল হাতে নিলেও ছিলেন বিবর্ণ। ৭১ রানের জুটির ৪২ রানই করেছেন অশ্বিন। ডানহাতি এ অলরাউন্ডারের টেস্ট সেঞ্চুরি আছে পাঁচটি। রান করেছেন প্রায় তিন হাজার। আজ সেই অভিজ্ঞতা দেখিয়েছেন মিরপুরের ২২ গজে।
ভারত লক্ষ্যের পথে যতটা কাছে গিয়েছে বাংলাদেশের বোলিং ততটাই ধারহীন হয়েছে। মিরাজ শেষ ওভারে এক ছক্কা, দুই চার ও এক ডাবলসে ১৬ রান দিয়ে ভারতকে সহজেই জয় এনে দেন। ৩ উইকেটের জয়ে ভারত শিবিরে ফিরেছে স্বস্তি। সঙ্গে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ১২ পয়েন্ট পাওয়ায় জয়ের হাসিটা আরও চওড়া হয়েছে। বিপরীত চিত্র বাংলাদেশ শিবিরে।
এ হারে যেন জড়িয়ে আছে তৃপ্তি মেশানো আফসোস। সাকিব পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে যেন সেই কথাটাই বললেন, ‘ছেলেরা যেভাবে লড়েছে তাতে আমি গর্ব খুঁজে পাচ্ছি। এভাবেই আমাদের সাফল্যের পথ খুঁজে বের করতে হবে।’ ঘড়িতে বাজে তখন ১১টা ১৮। অতৃপ্তি, আফসোস, হায় হুতাশের সুর ছড়িয়ে মিরপুরের শোনা যায়, ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে//শেষ হয়ে হইলো না শেষ…।’