ফুটবলের রাজা পেলে, তিনটি বিশ্বকাপ জয়ী একমাত্র ফুটবলার। দীর্ঘ এক মাস ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হার মানলেন। ‘সুন্দর খেলার’ বাহক বৃহস্পতিবার না ফেরার দেশে চলে গেছেন ৮২ বছর বয়সে।
২০২১ সাল থেকে কোলন ক্যানসারের চিকিৎসা চলছিল পেলের। নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় গত এক মাস ধরে সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। স্থানীয় সময় বিকেল ৩-২৭ মিনিটটে তার মৃত্যু হয়। তার বিভিন্ন অরগ্যান অকেজো হয়ে পড়েছিল।
সোমবার ও মঙ্গলবার তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে। তার কফিন প্রদর্শন করবে সান্তোসের রাস্তায়। যেখানে তার ক্যারিয়ারের গল্প শুরু, সেখানেই হবে দাফন।
তার মেয়ে কেলি নাসিমেন্তো ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, ‘তোমাকে ধন্যবাদ বাবা। তোমাকে অন্তিম ভালোবাসা, শান্তিতে ঘুমাও।’ পেলের এজেন্ট জো ফ্রাগা তার মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন, ‘রাজা চলে গেছেন।’
সান্তোসের ভিলা বেলমিরো স্টেডিয়ামে সোমবার ও মঙ্গলবার হবে পেলের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। বিদায়ী ব্রাজিলিয়ান প্রেসিডেন্ট জেয়ার বোলসোনারো কিংবদন্তির মৃত্যুতে তিনদিনের শোক ঘোষণা করেছেন এবং এক বার্তায় বলেছেন, ‘পেলে ছিলেন একজন সেরা নাগরিক ও দেশপ্রেমিক। যেখানেই গেছেন ব্রাজিলকে তুলে ধরেছেন।’
ব্রাজিলের ফুটবলকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন পেলে। তার এই যাত্রা শুরু সাও পাওলোর রাস্তায়। মোজার ভেতরে কাগজ ভরে ফুটবল বানিয়ে তাতে লাথি দিয়ে শুরু। ফুটবলের সেরাদের তালিকায় শুধু তার পাশে প্রয়াত ডিয়েগো ম্যারাডোনা, লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর নাম উল্লেখ করা হয়। সব মিলিয়ে তার নামের পাশে গোল ১২৮১টি।
বিশ্বে দ্য কিং হিসেবে পরিচিতি পান মাত্র ১৭ বছর বয়সে। সুইডেনে ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে টুর্নামেন্টের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে জেতেন ট্রফি। ফাইনালে স্বাগতিক দলের বিপক্ষে ব্রাজিলের ৪-২ গোলের জয়ে দুটি গোল করে সতীর্থদের কাঁধে চড়ে বিশ্বজয়ের হাসি কখনও ভুলে যাওয়ার নয়।
পরের বিশ্বকাপ শিরোপা ধরে রাখার অভিযানে ইনজুরির কারণে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলেন পেলে। কিন্তু মেক্সিকোতে ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ জয়ে তিনি ছিলেন নায়ক। ইতালির বিপক্ষে ৪-১ গোলে ফাইনাল জয়ে গোল করেন এবং করান কার্লোস আলবার্তোকে দিয়ে।
পেলে এতটাই খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন যে ১৯৬৭ সালে নাইজেরিয়া তাদের গৃহযুদ্ধে বিরতি টানে যেন দেশটিতে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে পারেন তিনি। ১৯৯৭ সালে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাকে নাইট উপাধি দেন। উত্তর আমেরিকায় ফুটবলকে জনপ্রিয় করতে ওয়াশিংটনে সেবার ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান প্রথমে হাত বাড়িয়ে দেন, বলেছিলেন, ‘আমার নাম রোনাল্ড রিগান। আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আপনাকে নিজের পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই কারণ সবাই জানে পেলে কে?’
ফুটবল জীবন শেষে পেলে নানা ভূমিকায় ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিক- ব্রাজিলের ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। একজন সম্পদশালী ব্যবসায়ী এবং ইউনেস্কো ও জাতিসংঘের অ্যাম্বাসেডরও ছিলেন।
স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় ঘর আর হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন পেলে। ব্রাজিলের ১৯৭০ বিশ্বকাপ দলের প্রতিনিধি হিসেবে তার মূর্তি উন্মোচনের অনুষ্ঠানেও ছিলেন না। ৮০তম জন্মদিন পরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে ঘরে কাটান।
১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর মিনাস গেরাইসের ছোট শহর ট্রেস কোরাকোয়েসে জন্ম পেলের। ফুটবলের সরঞ্জাম কিনতে জুতা পালিশ করতেন। ১১ বছর বয়সে দৃষ্টি কাড়েন তিনি। একজন পেশাদার খেলোয়াড় তাকে সান্তোসের যুব দলে নিয়ে যান। সিনিয়র দলে ঢুকতে বেশি সময় লাগেনি। ১৯৫৬ সালে ১৬ বছর বয়সে ব্রাজিলিয়ান ক্লাবে অভিষেক এবং বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় ঘর আর হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন পেলে। ব্রাজিলের ১৯৭০ বিশ্বকাপ দলের প্রতিনিধি হিসেবে তার মূর্তি উন্মোচনের অনুষ্ঠানেও ছিলেন না। ৮০তম জন্মদিন পরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে ঘরে কাটান। তারপর থেকে খুব একটা দেখা যায়নি প্রকাশ্যে। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে হাসপাতালে যাওয়া আসার মধ্যে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত হার মানলেন জীবনযুদ্ধে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে কোলন টিউমার অপসারণ করান পেলে। তার পরিবার কিংবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কেউ বলেনি আর কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে ক্যানসার। গত ২৯ নভেম্বর করোনা নিয়ে আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে ফেরেন এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ধরা পড়ে। গত সপ্তাহে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানান, তার ক্যানসারের অবনতি হয়েছে। বড়দিনও তার সঙ্গে হাসপাতালে করেছেন তার সন্তানরা। ব্রাজিলিয়ান গ্রেটের মৃত্যুশয্যায় পাশে ছিলেন তারা।