এক জটিল সমীকরণের নাম অর্থনীতি। কোনটা রেখে কোনটা বাদ দেবেন। চাহিদা- যোগানের মাধ্যমে যে সমাধান করা হয় এর বাইরে অনেক কিছুই অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন করতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কথাই ধরুন। মানুষের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সাথে সাথে এখন লেনদেনেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ই-কমার্সের সাথে এখন এফ-কমার্স যোগ হয়েছে।
শুরুতে মানুষের আচার-আচরণের সাথে দর্শন শাস্ত্রের আদর্শ যোগ হয়ে যে আলোচনা হতো আজকের অর্থনীতি তার থেকে অনেক দূরে। গণিত আর পরিসংখ্যানের প্রভাবে অর্থনীতির মূল উপজীব্য এক বীভৎস (!) রূপ লাভ করেছে। মানুষের আচরণকে গণিতের ছকে ফেলার যে প্রচেষ্টা তা কতখানি সফল তা সময়ই বলে দেবে।
আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু অর্থনীতির বিভিন্ন ইস্যু যা আমরা নিয়মিত প্রত্যক্ষ করি। সকল অর্থনীতিতেই ক্রেতা-বিক্রেতাগণ বিভিন্নভাবে পরস্পরকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। বড় মাছ কিনতে গেলে দেখা যায় বিক্রেতা মাত্র একটি মাছ তার ডালায় সাজিয়ে রেখেছেন যাতে ক্রেতা এ রকম মনে করেন যে সর্বশেষ মাছ হিসেবে এর দাম কম হবে। যদিও আসলে তেমনটি নয়, পাত্রে রাখা মাছটি বিক্রি হবার পর আরেকটি মাছ তিনি ঝুলি থেকে বের করেন। ক্রেতার মনস্তত্ত্ব জয় করাই বিক্রেতার আসল উদ্দেশ্য। ভোক্তাকে আকৃষ্ট করার আরেকটি উদাহরণ দেই। ঢাকা শহরে অনেকে ফেরি করে তথাকথিত (!) গরুর দুধ বিক্রি করেন। এসব দুধ অনেকগুলো কন্টেইনারে রাখা থাকে, যদিও এগুলো একত্রে আসে বলেই আমার ধারণা। বিক্রেতা তার মতো করে বিভিন্ন পাত্রে সেগুলো সজ্জিত করেন। ক্রেতাকে ধোঁকা (!) দেওয়ার জন্য দুধের উপর কচুরিপানাও দিয়ে থাকেন যেন এর মান নিয়ে ভোক্তার সন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়।
ইদানিং ঢাকা শহরের গণপরিবহনে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে- ইলেক্ট্রনিক টিকেটিং সিস্টেম। বিশেষ করে, মিরপুর থেকে আজিমপুর পর্যন্ত দেখা যায় লোকাল বাসে এভাবে টিকেট দেওয়া হচ্ছে। ভাড়া নিয়ে নগর জীবনে প্রতিনিয়ত যে জটিলতা তার সাথে এ সিস্টেম যোগ হয়ে আরও সমস্যা তৈরি করেছে। এসব ই-টিকেটে অনেক স্থান উল্লেখ নেই, ভাড়াও একটু বেশি। তবুও কাস্টমারদের কাছ থেকে এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে তা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, আমাদের অসহিষ্ণু জীবনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো গণপরিবহনে যাত্রী ও বাস কন্ডাক্টরদের ভাড়া নিয়ে বাহাস।
ভোক্তাদের দাঁড়ানোর জায়গা ক্রমে ছোট হয়ে আসছে। পণ্যের গুণগত মান নিয়ে ভোক্তার অসন্তুষ্টি অনেক। গবেষণার ফল হিসেবে কেউ একজন বলেছিলেন, বাংলাদেশে যে পরিমাণ আম উৎপাদিত হয় তা যদি নষ্ট না হতো, কাঁচা অবস্থায় খাওয়া না হতো, কিংবা পচে না যেত তাহলে যে পরিমাণ পাকা আম পাওয়া যেত তার চেয়ে অনেক বেশি আমের জুস বাজারে পাওয়া যায়। মশা যদি কয়েলের উপর বসে থাকে তবে কী হবে সে কয়েল দিয়ে? অনেকটা, ভিক্ষুকমুক্ত এলাকার সাইনবোর্ডের নিচে ভিক্ষুক বসে থাকতে দেখার মতো। এছাড়া, অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্যের গুণগত মান কমিয়ে এর দাম ভোক্তার নাগালের মধ্যে রেখে ব্যবসা করতে চান। ফলে গ্রেসামের সূত্র অনুসারে নিম্নমানের পণ্য ভালোমানের পণ্যকে বাজার থেকে বের করে দিচ্ছে। পণ্যের গুণগত মান হ্রাস পেলে দীর্ঘমেয়াদে মানুষের কর্মদক্ষতা কমবে।
এখানে একটি প্রসঙ্গ আসতেই পারে। দাম বেশি হলে কী মানুষ পণ্য কিনবে না? এক শ্রেণির মানুষ অবশ্যই কিনবে। সমস্যার মূল জায়গা অধিক দাম নয়; বরং বাজারের উপর মানুষের আস্থা। যদি ডিমের উদাহরণ দেই তাহলে দেখা যাবে দেশি মুরগি বা মুরগির ডিম যদি অনেক দামিও হয় তবু এর অনেক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমরা তা চিনতে পারি না। একইসাথে বিক্রেতার কথার উপর ভরসা করতে হয়; কিন্তু আমরা ভরসা করতে ভয় পাই। ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে ‘ইনফরমেশন গ্যাপ’ থাকার কারণে সাদা-কালোর (black & white) বিপরীতে এক ধুসর (grey) অর্থনীতি দেখা যাচ্ছে।
আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে আপ্লুত হই। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বিশ্বাস করি না। ইদানিং এরকমও দেখা যায়, ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে কোনো পণ্য নিয়ে অনেকে ইতিবাচক মন্তব্য করছেন। মানুষ সেটিও বিশ্বাস করছেন না। কারণ তারা মনে করছেন এগুলো সব বিক্রেতার নিজেদের মানুষ দিয়ে সাজানো মন্তব্য। এছাড়া, ‘শর্ত প্রযোজ্যের’ আড়ালে মানুষকে বোকা বানানোও সম্ভব হচ্ছে। বিক্রেতাগণ একটা বিষয় বারবার ভুলে যাচ্ছেন। তিনি শুধু এক/দুইটি পণ্য বা সেবা বিক্রি করছেন। পক্ষান্তরে, বাজার থেকে অন্যান্য পণ্য/সেবা তাকে কিনতে হয়। ফলে আখেরে তিনিও সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এসব কিছুর নেপথ্যে আমাদের লোভ কাজ করছে। সবাই বিনা পরিশ্রমে খুব সহজে বিত্তশালী হতে চান। জমির দাম ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণ আপনি যে জমি ১০০ টাকা দিয়ে কিনতে চান আমি সেটা ১০০০ টাকা দিয়ে কেনার জন্য বায়না করতে রাজি। এর মাঝে আবার কেউ কেউ অনেক বেশি অপচয় করছেন। রেস্টুরেন্টে গিয়ে অনেক খাবার অর্ডার করে আমরা অহেতুক খাবার নষ্ট করছি যেখানে অনেকে ফেলে দেওয়া খাবার কুড়িয়ে খাচ্ছেন। খাবার নিয়ে খুব বেশি বলার নেই। শহুরে জীবনে খাবার খাওয়াই এখন সবচেয়ে বড় বিনোদন। সাথে যোগ হয়েছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কন্সট্রাকশন কাজ দেখা!
ইদানিং বাংলা নাটকের কাহিনী ও সংলাপ নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। নাটকে যা দেখাচ্ছে তা ঠিক বা ভুল সেটি অন্য ইস্যু। বাজার যদি কোনো কিছুকে গ্রাহ্য করে তাহলে সমালোচনায় আসলে কিছু যায়-আসে না। আপনি কীভাবে বাজার অস্বীকার করবেন? বাজার অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী যাকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেকে অসম্ভব বলেও বিবেচনা করেন। বাজার অর্থনীতির এ শক্তিশালী প্রভাবের কারণে সবাই ‘ভাইরাল’ হতে চান। প্রাসঙ্গিক, অপ্রাসঙ্গিক যে কোনোভাবে ভাইরাল হওয়াই মুখ্য। জীনের সাথে বসবাস করা হোক আর চুরি করে সেলিব্রেটি হওয়ার বিষয় হোক – ভাইরাল হয়ে বাজার দখল করাতেই সাফল্য ধরা দিচ্ছে! বাজার অর্থনীতিতে অনেক প্রতিযোগিতা থাকলেও মজার বিষয় হচ্ছে ভিক্ষুকগণের মাঝে তা দেখা যায় না। একজনকে ভিক্ষা দিলে সে পাশের জনকে ভিক্ষা নেওয়ার জন্য দেখিয়ে দিচ্ছে।
একটি দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য উদ্ভাবনের গুরুত্ব অনেক যা কার্যত উৎপাদন উপকরণের দক্ষতা বাড়ায়। কিন্তু উদ্ভাবনের জন্য ইনসেন্টিভ থাকতে হয়। ঠিক যে কারণে সকল দেশেই বেসরকারি খাতের উদ্ভাবনী শক্তি সরকারি খাতের চেয়ে বেশি। যুতসই উদাহরণ দেই। ইদানিং লক্ষ্য করবেন বরিশালের আমড়া পুরাটা বিক্রি হয় না; বরং কেটে ছোট করে বিক্রি করা হয়। এর প্রধান কারণ, কেটে বিক্রি করলে আমড়ার আকার কিংবা এর অন্যান্য গুনাগুণ পরখ করার সুযোগ থাকে না। ফলে নিম্নমানের আমড়াও বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে। আবারও গ্রেসামস ল’ কাজ করছে। এটা একধরনের উদ্ভাবন যা বিক্রেতাকে শেখাতে হয় না। বিক্রেতাগণ নিজের তাগিদেই শিখে নেন। চা স্টলে যে চামচ দিয়ে চা বানানো হয় সেটি আসলে লম্বা বোতলের চামচ (মূলত আচারের জন্য ব্যবহৃত চামচ)। চামচ খাটো হলে চা বানাতে দেরি হবে, বিক্রি কম হবে। এগুলোই অর্থনীতির উদ্ভাবনী শক্তি। উদ্ভাবন দেখতে হলে ঢাকা শহরের ছোট ছোট টং দোকানের দিকে তাকাতে হবে। কী নেই সেসব দোকানে? কিংবা কত ছোট জায়গায় বসে তারা ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন হলো মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে সেবা প্রদান। ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। করোনাভাইরাসের অতিমারির সময় সরকার সফলতার সাথে এ সার্ভিস প্রয়োগ করে মানুষের হাতে নগদ অর্থ পৌঁছে দিয়েছে। তবে ‘ডিজিটাল অর্থনীতি’ হতে পারে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের আগামী দিনের সবচেয়ে বড় অর্জন।
একটি অর্থনীতি সকল খাতকে একত্রে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। সামষ্টিক অর্থনীতির এগিয়ে চলায় ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গাণিতিক মারপ্যাচের মধ্যেও ভোক্তার আচরণ অর্থনীতির এগিয়ে চলায় ভূমিকা রাখে। মনে রাখতে হবে, ভোক্তার সমষ্টিই আসলে অর্থনীতি।
উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক