জাতির পিতার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নানা সময়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা। দৈবক্রমে তিনি বেঁচে গেলেও এই হত্যাচেষ্টার ঘটনাগুলো, কালো অধ্যায় হয়ে আছে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ক্ষমতায় কিংবা ক্ষমতার বাইরে থাকলেও সবসময় তিনিই ঘাতকের বুলেট-বোমার টার্গেট ছিলেন। কার্যত ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যা সম্পূর্ণ করতে পারেনি, সেটাই বারবার করার চেষ্টা করেছে, এখনও করে যাচ্ছে স্বাধীনতার পরাজিত ঘাতক শক্তি। পিতার স্বপ্নপূরণে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরেছিলেন শেখ হাসিনা। সেই থেকেই প্রতিটি মুহূর্ত ঘাতকের নিশানায় তিনি। যে বুলেট দুইবোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া জাতির পিতাসহ পরিবারের সবাইকে পৃথিবীছাড়া করেছিল, সেই বুলেট শেখ হাসিনার পিছু নেয় দেশের মাটিতে পা রাখার পর থেকেই। কখনো সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, কখনো বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং তাদের অনুসারীদের মদদে কখনো বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী গোষ্ঠীর ইন্ধনে এবং সরাসরি সহযোগিতায়। প্রতিটি হামলায় শেখ হাসিনাই ছিলেন মূল টার্গেট। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বারবার বুলেট-বোমা তাড়া করে বেড়ায় তাকে? কেন বারবার হত্যাকারীদের মূল টার্গেট শেখ হাসিনা? বিস্ময়কর যে, প্রতিটি ঘটনায় রাজনৈতিক যোগসূত্র মিলে যায় ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারি দলগুলোর কার্যক্রমের সঙ্গে।
তবে শেখ হাসিনার সাহস তাকে পরাভূত হবার সব শক্তিমত্তা পর্যুদস্ত করে দেয়। তেজস্বী মনোভাব নিয়ে তিনি এগিয়ে চলছেন। কোনো বাধা বিপত্তি তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আদর্শে ও লক্ষ্যে অবিচল নিষ্ঠা, কর্মকূশলতা, দক্ষতা, যোগ্যতা তাকে ধরে রাখে বাঙালির অন্তরে, মানুষের জেগে ওঠার, বেড়ে ওঠার আবেগে। সবুজ শ্যামলে জড়ানো বাংলাদেশকে পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় উন্নীত করতে দিনরাত কাজ করছেন তিনি। একাত্তরের পরাজিত শক্তি এখনো ওঁৎপেতে আছে প্রতিশোধে। পঁচাত্তরের ঘাতক বাহিনী, যারা হত্যা করেছে পিতা-মাতা-ভাইসহ স্বজনদের, তারা চায় তার বিনাশ। তাকে নিধন করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী পূর্ব-পাকিস্তানি ধারায় ফিরে যেতে চায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর দেশটাকে তারা পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে তিনি ফিরিয়ে এনেছেন জাতির পিতার স্বপ্নে সোনার বাংলার পথে। সেই পথ মসৃণ নয়। অনেক চড়াই-উৎরাই। সেসব পথ মাড়িয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন।
পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সেই ১৯৮১ সাল থেকে জনগণের ভোট-ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠায় চলার পথে তাকে ২১ বার হত্যার চেষ্টা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় দলীয় নেতা-কর্মীরা জীবন দিয়ে তাদের প্রিয় নেত্রীকে রক্ষা করেছে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, এই পর্যন্ত শেখ হাসিনার হত্যাচেষ্টা রুখতে গিয়ে ৬৬ জন নেতা-কর্মী-সমর্থক প্রাণ দিয়েছেন। তার একটি ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের। তখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল সময়ের কথা। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করে স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ। আহত হন কমপক্ষে তিন শতাধিক মানুষ। নিহত যাদের লাশ পাওয়া গেছে তারা হলেন- হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথলেবারট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডিকে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বিকে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, মসর দত্ত, হাশেম মিয়া, মো. কাশেম, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ, মো. শাহাদাত। জানা যায়, সেদিন শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি চালালেও এক পুলিশ সদস্যের রাইফেলের কানেকশন বেল্ট খুলে পড়ায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। ইতিহাসে এই দিনটিকে চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিরণীতে জানা যায়, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে মুখিয়ে ছিল সারাদেশ। তৎকালীন ১৫ দলীয় জোট নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার আগমণের প্রহর গুণছিল লাখো ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী জনতা। বেলা দেড়টার দিকে শেখ হাসিনার গাড়ি কোতোয়ালী থানা হয়ে পুরনো বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন অতিক্রম করছিল। এ সময় স্বৈরশাসকের পেটোয়া বাহিনী মুক্তিকামী জনতার গণজোয়ার দেখে ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাই সমাবেশ বানচাল করে দিতে তৎকালীন সিএমপি কমিশনার (পাকিস্তান প্রত্যাগত পাকিস্তানি সেনা সদস্য) রকিবুল হুদার নির্দেশে গর্জে ওঠে পুলিশের রাইফেল। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে নেত্রীকে বাঁচাতে মানববর্ম তৈরি করেন। গুলিবর্ষণের পর আইনজীবীরা মানববেষ্টনি তৈরির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে রক্ষা করে আইনজীবী সমিতি ভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অতর্কিত গুলিতে ঝরে পড়ে কতগুলো তাজা প্রাণ।
সেদিনের সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী এবং আইনজীবী, চিকিৎসকসহ বহু লোক শহীদ হন। আহত হন আরও প্রায় তিন শতাধিক। যদিও নিহতের সংখ্যা বলা হচ্ছে ২৪ জন, কিন্তু এ সংখ্যাটা আরও বেশি। কারণ, সেদিন অনেক লাশ গুম করে ফেলা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা নিহতের সংখ্যা ৩০ জন। কারও কারও মতে সেটি ৩৬ জন। লাশ গুম করে ফেলার কারণে সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, নৃশংসতার একপর্যায়ে পুলিশের কড়া পাহারায় নিহতদের রাতের আঁধারে নগরীর অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়। উল্লেখ্য, সেই নারকীয় হত্যাকান্ডে নিহতদের স্মরণে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের প্রধান ফটকে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে নিহত ২৪ জনের নাম লিপিবদ্ধ করা আছে।
এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ নিহতদের পক্ষে আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদী হয়ে চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় হত্যাকান্ডের সময় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনারের দায়িত্বে থাকা মির্জা রকিবুল হুদাকে প্রধান আসামি করা হয়। এতে রকিবুল হুদাকে ‘হত্যার নির্দেশদাতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। জামায়াত-বিএনপি সরকারের আসলে মামলাটির অগ্রগতি থামিয়ে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯১ সালে পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল এই পুলিশ কর্মকর্তাকে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। আদালতের আদেশে সিআইডি মামলাটি তদন্ত করে ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথম এবং অধিকতর তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রে তৎকালীন সিএমপি কমিশনারসহ ৮ পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়। মামলার ৩২ বছর পর ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে ৫ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে এ গণহত্যা চালানোর জন্য ঢাকা থেকে যারা নির্দেশ দিয়েছিল তাদের আইনের আওতায় আনা হয়নি।
এই হামলার নেপথ্যে কারা ছিল, হামলার উদ্দেশ্য কী ছিল এবং এই ঘটনায় তৎকালীন সরকারের সম্পৃক্ততার তথ্য আদালতের রায়ে এখন অনেকটাই স্পষ্ট এবং দেশবাসীও তা অবহিত। এখন অন্তরালের অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। এ ধরনের বর্বর ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক এটা প্রত্যাশা সবার। হত্যার মাধ্যমে কাউকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভাষা নয়। এ ধরনের অপরাজনীতিতে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে না। এই হত্যাচেষ্টার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক ধারাকে কলুষিত করেছে। তবে একথা সত্য যে, যারা এই হামলা করেছিল, তারা এবং তাদের উত্তরসূরিরা মুখোশ বদল করে এখনও সক্রিয়। এ জন্য এখনও সতর্ক দৃষ্টি রাখা সংগত।
বিপদে পালিয়ে যাওয়া নয়; জনগণের পাশে থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে রুখে দাঁড়ানোর নামই আওয়ামী লীগ, এর নাম শেখ হাসিনা, এটা দেশবাসীর কাছে বারবার প্রমাণিত। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার ওপর যতবারই হামলা হয়েছে, হত্যার চেষ্টা হয়েছে, ততবারই আরও সুসংগঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের কর্মীরা বারবার ত্যাগের প্রমাণ দিয়েছে দল এবং নেত্রীর জন্য। সময়ের প্রয়োজনে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন অসংখ্য কর্মী। আজ প্রতিহিংসার নৃশংসতম সেই ভয়াল দিন ২৪ জানুয়ারি। নেত্রীর জীবন বাঁচাতে যারা সেদিন জীবন দিয়েছেন, যারা মানববর্ম তৈরি করে নেত্রীকে বাঁচিয়েছেন তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)