সাতসতেরো

নাদেরা বেগম হয়ে উঠেছিলেন দুর্ধর্ষ রোমাঞ্চ উপন্যাসের নায়িকা

ভাষা আন্দোলনের সম্মুখ সারির যোদ্ধা ছিলেন নারীনেত্রী নাদেরা বেগম। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য  আন্দোলনের শুরুতে প্রথম যে ছোট মিছিলটির ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ হয় তার সামনের সারিতে ছিলেন স্বল্পসংখ্যক ছাত্রী। এই ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ছাত্রী নাদেরা বেগম। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে অত্যন্ত পরিচিত নাম নাদেরা বেগম। তৎকালীন রাজনীতিতে তিনি ছিলেন এক কিংবদন্তি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে খুব কমসংখ্যক নারী উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন, তারমধ্যে মুসলিম নারীরা ছিলেন সংখ্যায় আরো নগন্য। সে সময়ের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় নারীরা স্কুল কলেজে পড়াশোনা শেষ করে সংসারধর্ম করবে; এটাই ছিলো স্বাভাবিক সামাজিক নিয়ম। সেই গতানুগতিকতার বাইরে এসে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও স্বৈরশাসনবিরোধী কর্মকাণ্ডে নাদেরার উপিস্থিতি ছিলো অত্যন্ত সরব। 

নাদেরা ১৯২৯ সালের ২ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদুল হালিম চৌধুরী ছিলেন ব্রিটিশ শাসনামলের পদস্থ কর্মকর্তা। চৌদ্দ ভাই-বোনের মধ্যে নাদেরা ছিলেন তৃতীয়। বড় দুই ভাই অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রজীবনেই সমাজতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তৎকালীন সরকারের নির্দেশে ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীকে বহিষ্কার ঘোষণা করে। যাদের মধ্যে একমাত্র ছাত্রী ছিলেন নাদেরা।

ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নের অন্যতম সংগঠক তিনি। ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত সভায় তিনিও ছিলেন। সেই সভায় পুলিশি অ্যাকশনে তিনি আহত হন। ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে কামরুন্নেসা বিদ্যালয়, বাংলাবাজার বিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে তিনি নারীদের উদ্বুদ্ধ করতেন। পরবর্তীতে এসব নারীরা ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। 

অন্যান্য ভাষা সংগ্রামীদের স্মৃতিচারণ থেকে ’৫২ সালে নাদেরার সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা জানা যায়।  জানা যায়, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি আন্ডার গ্রাউন্ডে থেকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। ভাষাসৈনিক ড. হালিমা খাতুন পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘নাদেরা বেগম তখন আন্দোলনের কিংবদন্তি নায়িকা। অনেকবার জেল খেটেছেন। ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে আমি নাদেরা বেগমের কাছ থেকে চিঠি লিখিয়ে আনি। মেয়েরা পরদিন সকালে আমতলার সভায় অংশগ্রহণ করে। তার চিঠির ভাষা ছিল এমন- বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এটাকে প্রতিহত করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাও।’ ভাষা আন্দোলনের তৎপরতাকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ফেব্রুয়ারির ১২ ও ১৩ তারিখে পালিত হয় ‘পতাকা দিবস’। এ সময় নাদেরা বেগম ও শাফিয়া খাতুনকে পাঁচশ পোস্টার লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়। তাঁরা দুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রী ও অন্যান্য ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করেন। 

নাদেরা ছাত্রীদের সংগঠিত করা, রাত জেগে পোস্টার লেখা, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তোলার কাজে মেয়েদের সহযোগিতা করা, নারী-নেত্রীদের সঠিক দিক-নির্দেশনা দানে অত্যন্ত পটু ছিলেন। ভাষা আন্দোলন ও সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণের দায়ে বিভিন্ন সময়ে তিনি কারারুদ্ধ হন। অন্যান্য রাজবন্দীদের সাথে কঠোর নির্যাতনের শিকারও হন। নাটকীয়ভাবে পুলিশের চোখের সামনে থেকে দুবার পালিয়ে, আত্মগোপন করে, বিভিন্ন পরিচয়ে, বিভিন্ন জায়গায় বাস করে নাদেরা যেভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন তাতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কোনো এক দুর্ধর্ষ রোমাঞ্চ উপন্যাসের নায়িকা।  পরবর্তী সময়ে রাজনীতি থেকে সরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেন। তার স্বামী গোলাম কিবরিয়া ছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থসচিব ও মহা-হিসাবনিরীক্ষক। 

লেখক: গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী