শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেনের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১ নভেম্বর। সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু। শিশুসাহিত্যে তাঁর পদচারণা দীর্ঘদিনের। বই সম্পাদনা করে প্রশংসিত হয়েছেন। শিশু একাডেমি থেকে ৫ খণ্ডে প্রকাশিত শিশু-বিশ্বকোষের তিনি অন্যতম সম্পাদক। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্যও তিনি গান লিখেছেন। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। শুদ্ধতম বিরল এই শিশুসাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুজাহিদ বিল্লাহ।
মুজাহিদ বিল্লাহ : আপনার মুখ থেকে শিশুসাহিত্যিক হয়ে ওঠার গল্পটা শুনতে চাই।
আখতার হুসেন : আমারও একটা শৈশবকাল কেটেছে, আমি নিজেও দুরন্ত ছিলাম। বিশ্বসাহিত্যের কিছু শিশুসাহিত্য পড়ে আমি ঠিক করলাম আমি শিশুসাহিত্য লিখব। যদিও প্রথমে আমি বড়দের লেখা দিয়ে শুরু করেছিলাম।
মুজাহিদ বিল্লাহ : সেই শুরুটা কখন, কবে থেকে হলো?
আখতার হুসেন : আমার আসলে বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। যেমন আমি এক সময় প্রচুর ভালো ছবি আঁকতাম। ক্রিকেট খেলতাম, ব্যাডমিন্টন ভালো খেলতাম, ফুটবল ভালো খেলতাম। গানের প্রতিও অনেক নেশা ছিল, শেখার চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু সেই দিকে আর যাওয়া হয়নি। রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলাম। সব কিছু মিলিয়ে দেখলাম, শিশুদের যদি আমি ছোটবেলা থেকেই গড়তে না পারি, তাদের আলোকিত করতে না পারি, তাহলে তো তারা বড় হয়ে পথ হারাবে। যদিও আমরা বলে থাকি- শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। কিন্তু তারা যদি পথ হারায় তাহলে ভবিষ্যতের হাল ধরতে পারবে না। এ জন্যই শিশুদের জন্য তাদের চরিত্র গঠনে সহায়ক লেখা, তাদের কল্পনার রাজ্য বাড়ানোর জন্য লিখতে শুরু করি। আপনি যদি আমার লেখাগুলো পড়েন তাহলে দেখবেন, আমি যে কথাগুলো বলছি সেই কথাগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব পাবেন না। আমি যা বলছি বা বলি আমার রচনাতে তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি।
মুজাহিদ বিল্লাহ : আপনি যখন লিখতে শুরু করলেন, সেই সময়ের সঙ্গে এখন শিশুসাহিত্যে নিশ্চয়ই কিছু পার্থক্য রয়েছে? আপনার কী মনে হয়?
আখতার হুসেন : নাহ্। রবীন্দ্রনাথের কথা যদি বলি, তিনি শেষ বয়সে এসে ছবি আঁকতে শুরু করলেন, ছোটদের জন্য ছড়া লেখা শুরু করলেন। ছোটদের জন্য গল্পও লিখলেন। আমার যেটা মনে হয়, আমাদের যে ছাড়ার একটা সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে, সেই ছড়ার মান যথেষ্ট ভালো। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ শিশুসাহিত্য বলতে যা বোঝায় এখনকার শিশুসাহিত্যিকদের মধ্যে সেই অভাবটা পাবেন। যেমন ধরুন সুকুমার রায়, বিজ্ঞানের উপরে শিশুদের জন্য লিখেছেন। তিনি ‘ননসেন্স’ লেখা লিখেছেন, আবার সিরিয়াস লেখাও লিখেছেন, আবার নাটক লিখেছেন। এই যে নানা দিকে তাঁর বিচরণ, এটি আমাদের মধ্যে এখন বিরল। এখন যিনি ছড়া লিখছেন সে শুধু ছড়া লিখছেন, যে কিশোর কবিতা লিখছেন তিনি তাই লিখছেন। কিন্তু আমি চাই যিনি শিশুদের জন্য শিশুসাহিত্য লিখছেন তিনি হাসির গল্প লিখবেন, কথার গল্প লিখবেন, তিনি পুনর্লিখনও করবেন। তিনি নাটক লিখবেন, বিজ্ঞান নিয়ে ছোটদের উপযোগী করে লেখালেখি করবেন। আমাদের শিশুসাহিত্যে নাটকের খুব অভাব, উপন্যাসের খুব অভাব। সেবা প্রকাশনী থেকে শিশুদের জন্য লেখা প্রকাশ পায়, সেটা আলাদা একটা ধারা, তারা বাধা কিছু লেখকদের নিয়ে কাজটি করিয়ে নিচ্ছেন। আমাদের আরেকটা বিষয়ের অভাব, বড়দের জন্য ছবি আকার শিল্পী প্রচুর পাবেন কিন্তু ছোটদের ছড়া, গল্পের ভালো ছবি আঁকার, ছোটদের বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার শিল্পীদের খুব অভাব।
মুজাহিদ বিল্লাহ : শিশুসাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন যে প্রকাশক। তারাও অনেক সময় অবহেলা নিয়ে বইগুলো প্রকাশ করেন।
আখতার হুসেন : এই ব্যাপারটা আপনি না বললেও আমি বলতাম। কিছু প্রকাশক আছেন যারা ছোটদের বই অনেক ভালো প্রকাশ করেন কিন্তু বেশিরভাগই কাজটি যত্ন নিয়ে করেন না। ছোটদের বই যত যত্ন নিয়ে করা উচিত, যত সতর্কতার সঙ্গে ছাপানো উচিত সেটা হয় না। ছোটদের বইয়ে বানান ভুল বড় সমস্যা। ছোটদের বইয়ে বাক্য বড় করা যায় না। ক্লাস টু থেকে যারা ফাইভ পর্যন্ত লেখাপড়া করে তারা যেসব ছোটগল্প পড়বে বা রূপকথা পড়বে তার একটা সীমা থাকবে। বাক্য দীর্ঘ হলে তার কাছে জটিল লাগবে। লেখক যদি এই বিষয়টা না-বুঝতে পারেন তাহলে সমস্যা। আমাদের দেশে এডিটরও খুব একটা নেই। অনেক প্রকাশনী সম্পাদক রেখে কাজটি করেন না। এর কারণও রয়েছে, তাদের বেতন দেওয়া সব প্রকাশনার পক্ষে সম্ভব নয়।
এখানে আমার একটা পরামর্শ রয়েছে। কথাটি আপনি জোর দিয়ে লিখবেন। যদি ৪ জন এডিটরকে এক জায়গায় বসিয়ে প্রকাশকরা তাদের কাজগুলো ভাগ করে দেন, তাহলে কিন্তু কাজটি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে কয়েকজন প্রকাশক মিলে একটা এডিটর হাউজ করা যেতে পারে। এটা গরিব দেশের জন্য প্রযোজ্য। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এডিটর নিয়োগ দেওয়া।
আমাদের এখানে সত্যিই এগুলোর অভাব রয়েছে। আমাদের দেশে অনেক লেখক ভূতের, ডিটেকটিভ গল্প লেখে। সেবা প্রকাশনী এ ক্ষেত্রে একটা ধারা চালু করেছে কিন্ত ইন-জেনারেল সেটা কিন্তু খুব কম। যেমন হাসির গল্প কাইজার চৌধুরী ছাড়া কে লেখে? আমাদের হাসির গল্প নেই, রেমাঞ্চকর গল্প নেই। কিন্তু আমাদের ছড়ার একটা বড় সাম্রাজ্য আছে, কবিতারও ভালো অবস্থা রয়েছে। আমাদের উপন্যাস খুব বেশি নেই।
মুজাহিদ বিল্লাহ : বড়দের সাহিত্য এবং শিশুসাহিত্যের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?
আখতার হুসেন : বড়দের সাহিত্যে বড়দের মনস্তত্ব এবং ছোটদের সাহিত্যে ছোটদের মনস্তত্ব বুঝতে হবে। মূলত এখানে মনস্তত্ব ও ঘটনার ব্যাপার। ছোটদের বইয়ে বড়দের চরিত্র আসতে পারে কিন্তু সেখানে ছোটদের সঙ্গে মিলে গল্পটা গড়ে উঠবে।
মুজাহিদ বিল্লাহ : শিশুসাহিত্যিক হওয়ার জন্য কী গুণাবলি প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
আখতার হুসেন : (মৃদু হেসে) সহজ কথায় কি এর জবাব দেওয়া যাবে? প্রথম কথা যেটা হচ্ছে, আমার স্টাডি সহজ সরল হতে হবে। ছোটদের মতোই তাকে বুঝতে হবে। তাকে বুঝতে হবে ছোটবেলায় আমি কি চাইতাম, আমি কি স্বপ্ন দেখতাম। সেই জিনিসগুলোই যদি আমি বুঝতে পারি তবেই শিশুসাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবো।
মুজাহিদ বিল্লাহ : আপনাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায় না।
আখতার হুসেন : আমি ওই জিনিসটা পরিহার করেছি সচেতনভাবে। বয়স হয়েছে ৭৮ বছর। এখন ফেসবুকে গিয়ে নিজের প্রচার করব বা অন্যদেও সঙ্গে সময় ব্যয় করব এই সময় আমার নেই। আমার এখনো অনেক কিছু লেখার বাকি আছে।