সাক্ষাৎকার

বাংলা ভাষার কাছে জন্মঋণ আছে: আহমদ রফিক

ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ আহমদ রফিকের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। এ বিষয়ে রয়েছে তাঁর মৌলিক ভাবনা। কবি, রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক হিসেবেও তিনি খ্যাত। মাতৃভাষার সেবা করেছেন মনন ও যুক্তি দিয়ে। স্বপ্ন দেখেন শিশু-কিশোরদের জন্য নিরাপদ এক দেশ। স্বরলিপিকে এই ভাষাসংগ্রামী জানিয়েছেন তাঁর স্মৃতি ও স্বপ্নের কথা। 

স্বরলিপি:  ২১ফেব্রুয়ারিতে যে মিছিল হয়েছিল, মানুষ সংগঠিত হয়েছিল কীভাবে? আহমদ রফিক: এর কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। মিছিলটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তাৎক্ষণিক একটি ঘটনার প্রতিক্রিয়া ছিল মিছিলটি। যখন ১৪৪ ধারা জারি হলো, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বয়স্ক রাজনীতিবিদরা ঝামেলা এড়াতে চাইছিলেন। সেদিন নবাবপুরে আওয়ামী লীগ অফিসে মিটিংয়ে মাওলানা ভাসানী ছিলেন না বলে সভাপতিত্ব করেছিলেন আবুল হাকিম। তিনি বলেছিলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি একরকম, তোমরা ছাত্ররা ভাবছ আরেক রকম। এটার একটা ফয়সালা হওয়া দরকার। শোনো, সামনেই নির্বাচন, সরকারের সঙ্গে ঝামেলায় যাওয়া ঠিক হবে না। এখন তোমরা সিদ্ধান্ত নাও। ছাত্ররা নির্বাচনের জন্য সমঝোতায় যায়নি, তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা অমান্য করেছে, মিছিল করেছে। চার-পাঁচজনের বেশি মানে আট-দশজন গ্রুপ হয়ে দুপুর ১২টা নাগাদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে একত্রিত হওয়ার জন্য এগিয়েছিল। বর্তমান জগন্নাথ হলের কাছাকাছি। ছাত্ররা পরিষদ ভবনের সামনে গিয়ে শান্তিপূর্ণ ঘেরাও করতে চেয়েছিল। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটের দিকে পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো শুরু করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে জমায়েতের দিকে লক্ষ্য করে ছোড়া গুলিতে প্রথম শহিদ হন রফিকউদ্দিন আহমদ। এরপর তো আরো শহিদ হলো। আন্দোলন পরিণত হলো গণ আন্দোলনে। ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পড়লো দেশব্যাপী।

স্বরলিপি: ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জনগণ ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হলো কীভাবে? আহমদ রফিক: নবাববাড়ি থেকে, বিশেষ করে ঢাকার পঞ্চায়েতের সরদাররা প্রচার করে দিলেন, এই আন্দোলনের সঙ্গে হিন্দু এবং ভারতের লোকজন জড়িত। পুরান ঢাকার লোকজন প্রথমে তাই বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু, পুলিশের গুলিতে ছাত্ররা যখন শহিদ হলো, তার দৃঢ় প্রভাবে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয় স্থানীয় লোকজনের। প্রত্যেকে আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন।  মানুষ বলতে শুরু করল, ‘ছাত্র মাইরা হালাইছে’। ছাত্রদের প্রতি মানুষের যে আবেগ, ভালোবাসা তৈরি হলো, তা সহসা আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তুলল। জনগণ একাত্ম হলো বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে।

স্বরলিপি: বাংলা ভাষা ব্যবহারে শিশু-কিশোরদের জন্য আপনার পরামর্শ কী? আহমদ রফিক: তোমরা ভুল উচ্চারণ করো না। ভুল বানানে লিখ না। বাংলা ভাষাটা ভালোভাবে রপ্ত করো। এটা মায়ের ভাষা। বাংলা ভাষার কাছে তোমার জন্মঋণ আছে। অভিভাবক এবং শিক্ষক যারা আছেন, তারা একটু দেখবেন, শিশু-কিশোরদের মধ্যে বাংলা ভুল উচ্চারণের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এগুলো তারা যেন সংশোধন করে।

স্বরলিপি: আপনার কিশোরবেলা কেমন ছিল? আহমদ রফিক: বেশ ভালো ছিল। আমার কিশোরবেলা কেটেছে যশোর জেলায়। বড় ভাইয়ের চাকরি সূত্রে আমার পরিবার সেখানে ছিল। যশোরের নড়াইল শহরে বেশ ভালো সময় কাটিয়েছি। চিত্রা নদীর পাড়ে ঘুরে বেরিয়েছি। বই আনা, বই পড়া ছিল অন্যতম প্রিয় একটি কাজ। গল্পের বই, কবিতার বই সবই পড়তাম। বই কেনা ছিল আমার একটি শখ। তখনকার পরিবেশ ভালো ছিল বলা উচিত হবে না। কিন্তু, এখনকার তুলনায় ভালো ছিল। নিরাপদ ছিল।

স্বরলিপি: বর্তমান পরিবেশের কোন দিকটা শিশু-কিশোরদের জন্য নেতিবাচক বলে মনে করছেন? আহমদ রফিক: তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেই।

স্বরলিপি: কী হলে এই শিশু-কিশোরদের জন্য পরিবেশ নিরাপদ হতে পারে? আহমদ রফিক:  সমাজ পরিবর্তন ছাড়া হবে না। সমাজ পরিবর্তন করতে হলে গণতান্ত্রিক সম্প্রীতিমূলক শাসনব্যবস্থা দরকার। শৃঙ্খলিত জাতি দরকার। তবেই গণতান্ত্রিক সম্প্রীতিমূলক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজ পবিরর্তন ঘটানো যাবে। এছাড়া, শুধু তাত্ত্বিক কাজ দিয়ে সমাজ পরিবর্তন ঘটানো যাবে না। আমি যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়কাল ধরি, তাহলে সত্তর বছর হয়ে গেল। এই সময়ে যে রাজনৈতিক পরির্বতনের মধ্যে দিয়ে গেছে দেশ, তাতেও শিশু-কিশোররা নিরাপদ পরিবেশ পায়নি। দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এই বিষয়টাকে যদি বড় ইস্যু হিসেবে নিতে পারে, তাহলে একটা কিছু ঘটতে পারে। ধরা যাক, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ইলিয়াস কাঞ্চন কাজ করে যাচ্ছেন, তার কাজের সঙ্গে যদি শাসনব্যবস্থার মেলবন্ধন ঘটে, তাহলে এই আন্দোলনের উদ্দেশ্যে অনেকাংশে সফল হবে। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান যেই এগিয়ে আসুক না কেন, তার সঙ্গে শাসন ব্যবস্থার মেলবন্ধন ঘটতে হবে।