মাগুরা মেডিকেল কলেজে চলছে প্রকট শিক্ষক সঙ্কট। সেই সঙ্গে রয়েছে আবাসন খাত ও শ্রেণি কক্ষগুলোতে নানা ধরনের সমস্যা। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। অতিদ্রুত শিক্ষক ও বিদ্যমান সমস্যার সমাধান না হলে শিক্ষার্থীদের অনেক বিষয়ে জানার ঘাটতি নিয়েই শেষ হতে পারে পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবন বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি ৫০ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে মাগুরা মেডিকেল কলেজে। মেডিকেল কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও এখনো তা পাস হয়নি। এ পরিস্থিতিতে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের একটি অংশে কলেজটির শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাগুরা মেডিকেল কলেজে এখন চারটি ব্যাচ পড়াশোনা করছে মোট ১৮৫ জন শিক্ষার্থী। চলতি বছরেই নতুন ব্যাচে যুক্ত হবেন আরও ৫০ জন শিক্ষার্থী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাত্র কয়েকটি কক্ষ দিয়ে মাগুরা মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। সেসময় এই মেডিকেলে তেমন কোনো আসবাবপত্র ছিলো না। মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের পুরোনো ভবনের দ্বিতীয় তলার পুরোটা এখন মেডিকেল কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ধাপে ধাপে তিনটি লেকচার হল, আটটি টিউটোরিয়াল ক্লাসরুম, দুটি গবেষণাগার, কনফারেন্স রুম, লাইব্রেরি, শিক্ষকদের বসার কক্ষ, শিক্ষার্থীদের কমন রুমের মতো অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। কিন্তু এখনো মেয়েদের হোস্টেল, সব বিষয়ে আলাদা গবেষণাগারের মতো সংকট রয়ে গেছে।
মেডিকেল কলেজটির কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মিত না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান কোনো সঙ্কটই পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তবে শিক্ষার্থীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে শিক্ষক সঙ্কট।
মাগুরা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন বিভাগের ৯৭টি পদ রয়েছে। তবে বর্তমানে অধ্যক্ষসহ আছেন ২৫ জন। মন্ত্রণালয় অনুমোদিত জনবলকাঠামো অনুযায়ী কলেজে ১১ জন অধ্যাপক থাকার কথা। আছেন মাত্র একজন (অধ্যক্ষ)। সহযোগী অধ্যাপকের ১৯টি পদের মধ্যে খালি ১২টি। তিনজন চলতি দায়িত্বসহ আছেন সাতজন। সহকারী অধ্যাপক ১৯ জনের মধ্যে আছেন ১০ জন। এর মধ্যে একজন সহকারী অধ্যাপক বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গেছেন। খালি আছে আরও নয়টি পদ। অ্যানাটমি ও প্যাথলজি বিভাগে কিউরেটরের দুটি পদই ফাঁকা।
সবচেয়ে বড় সংকট প্রভাষক পদে। অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি, প্যাথলজি—প্রতিটি বিষয়ে ৪ জন এবং মাইক্রোবায়োলজি, কমিউনিটি মেডিসিন ও ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে ২ জন করে মোট ২৬ জন প্রভাষকের পদ রয়েছে এই মেডিকেল কলেজে। বর্তমানে এই পদগুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র ৪জন প্রভাষক। বাকি সবকটি পদই ফাঁকা। ল্যাব টেকনোলজিস্টসহ প্রশাসনিক যে ১৯টি পদ আছে, সেখানে শূন্য আছে ১৬টি পদ।
মাগুরা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. কামরুল হাসান বলেন, জনবল সঙ্কটের বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত জানাচ্ছি। তারা আশ্বাস দিয়েছেন সঙ্কট সমাধানের। শিক্ষার্থীরা যাতে বঞ্চিত না হন, সে কারণে প্রয়োজনে বাইরে থেকে শিক্ষক ও টেকনোলজিস্ট এনেও কাজ চালানোর চেষ্টা করছি। প্রভাষকের সঙ্কটই আমাদের বেশি ভোগাচ্ছে। এই সঙ্কটের কারণে শিক্ষকদের ওপর যেমন বেশি চাপ পড়ছে, শিক্ষার্থীদেরও হয়তো ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারছি না আমরা।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের শিক্ষক সঙ্কট সবচেয়ে বেশি। এই বিভাগে একজন প্রভাষক দিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। যেখানে কমপক্ষে একজন সহকারী অধ্যাপক ও দুজন প্রভাষক দরকার ছিলো।
এদিকে শিক্ষক সঙ্কটের কারণে শিক্ষার্থীদের ওপর কী প্রভাব পড়ছে, এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেডিকেল কলেজের দুজন সহকারী অধ্যাপক বলেন, এমন সঙ্কট নিয়েই যদি চলতে হয়, তবে শিক্ষার্থীদের জানার ঘাটতি থেকে যাবে। এখানে একেকটি বিভাগ একজন শিক্ষক দিয়ে চলছে। যে কারণে ওই এক শিক্ষককেই কয়েকটি ব্যাচের তত্ত্বীয় ক্লাস, ক্লিনিক্যাল ক্লাস, আইটেম পরীক্ষা, হাসপাতালে রোগী দেখার মতো কাজগুলো করতে হচ্ছে। ফলে শিক্ষকের ওপর যেমন অতিরিক্ত চাপ পড়ছে, তেমনি শিক্ষার্থীরাও সঠিকভাবে জানা থেকে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের চতুর্থ বর্ষের (প্রথম ব্যাচ) এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘নতুন মেডিকেলের শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা অনেক সুবিধা থেকেই বঞ্চিত। পুরোনো মেডিকেল কলেজগুলোতে একেকটি বিভাগে যেখানে একাধিক অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও প্রভাষক মিলে ক্লাস নেন; সেখানে আমাদের এই মেডিকেলে একজন শিক্ষককেই সবকিছু সামলাতে হয়। বিশেষ করে ক্লিনিক্যাল ক্লাসে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।’
তৃতীয় বর্ষের অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এখানে সব ধরনের সঙ্কটই আমাদের ভোগাচ্ছে। শিক্ষক সঙ্কটের কারণে আমাদের সন্ধ্যাকালীন ক্লাস কম হয়। সিনিয়র শিক্ষকদের ওপরও বাড়তি চাপ তৈরি হয়।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষকদের একজন বলেন, ‘আমরা যখন মেডিকেলে পড়েছি, সেখানে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, প্রভাষকসহ কয়েকজন মিলে একেকটা বিষয় পড়াতেন। সেই একই কাজ এখানে আমাদের একজনকে করতে হচ্ছে। ফলে এখানে শিক্ষার্থীরা শতভাগ পাচ্ছেন, এটা বলার কোনো সুযোগ নেই। এখানে যেহেতু মেডিকেল কলেজের নিজস্ব ক্যাম্পাস নেই, যে কারণে শিক্ষকেরা আসতে চান না।
মাগুরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলার পারলা ও গোয়ালখালী মৌজায় মোট ২৫ একর জমির নকশা ও বাজারমূল্য নির্ধারণ করে ‘মাগুরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ’ শীর্ষক প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) গত বছর পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেয়ে অর্থ ছাড় হলে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হবে।
মাগুরা, নওগাঁ, নেত্রকোনা, নীলফামারী-এই চার মেডিকেল কলেজ একসঙ্গে অনুমোদন পায় ২০১৮ সালে। চারটি মেডিকেল কলেজের জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়টি একটি প্রকল্প হিসেবে পাস হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।