১. বাস থেকে নেমে সে নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। ভালো লাগে না। আজ সে যেখানেই যাক ভালো লাগবে না, তবু সে চেষ্টা করে চলেছে। আরো আজব কাণ্ড! সে বুঝতে পারছে না, কেন আজ তার এই মনকে কোনো কিছু একটা ভালো লাগাতেই হবে?
কারো জীবন কারো মতো হয় না। কারো জীবনী পড়লে এটা আরো ভালোমতো বোঝা যায়। লিটন স্ট্র্যাচির জীবনীটাই সে একমাত্র পড়েছিল। স্ট্র্যাচি একেবারে আলাদা ধরনের মানুষ। তারা বড় মানুষ। মতিন, শিবুদা বা নেয়ামুল এবং সে সাধারণ মানুষ। তাও কেউ কারো মতো তো নয়। সবারই একটা আছে তো আরেকটা নেই। একটায় শান্তি আছে তো আরেকটায় দুর্গতি। মতিনকে তাও মনে হয় সে শান্তিতে স্থির হয়েছে। কারণ সে তার কাজের মঞ্জিল খুঁজে পেয়েছে। নেয়ামুল নিজেকে বলে- নাই যার মূল। তার নাম ‘নাইমূল’ হলেই ভালো হতো।
মতিন ধরেই নিয়েছিল, বারো ঘাটের ও বহু ঘটের জল খেয়ে তবে সে এবার একটু স্থির হলো। মতিন ‘বারো ঘাট’ বলতে বারোটা চাকরি ধরা ও ছাড়ার কথা বলে, কিন্তু ঘট বলতে তার ইঙ্গিতটা অন্যদিকে যায়। কিন্তু শিবুদা বলেছে, ওর জন্য এই অফিস, কেরানিগিরি নয়। এখনও সময় আছে। চাকরি করা মানে তো খোপে ঢোকা। চাকরিই যখন করবে তো শিক্ষকতার খোপই তোমার জন্য সবচেয়ে ভালো খাপ। তোমার এতেই যা একটু ভালো লাগতে পারে। তুমি খুবই স্টুডিয়াস সিরিয়াস স্টুডেন্ট ছিলে- এই ভরসায়ই বলছি। মতিন বলেছিল, ভালো লাগা, মন্দ লাগা এসব বায়বীয় বিষয়। পেটে ভাত, মাথার ওপরে ছাদ, আর কোনো কাজে নেশার মতো ডুবে থাকতে পারলে আর কী চাই! তা-ই কি সবসময় পারা যায়? সে তো পারে না।
কিছু সময় আসে, বা কোনো কোনো দিন আসে যখন কিছুই ভালো লাগে না। আবার কিছু সময় বা দিন আসে যখন সব কিছুই ভালো লাগে। ঘটনাটা তো নিজের ভেতরেই ঘটে। এই তো সেদিন নদীর পাড়ে এসে ভালো লেগেছিল। সেই নদী তো তেমনই আছে, বদল ঘটেছে নিজের ভালো লাগায়, মন্দ লাগায়। এমনকি আরেকদিন গভীর রাতে, তখন দুটো আড়াইটা বাজে। কাকির দাহ চলছে। শ্মশানটার পাশেই ব্রহ্মপুত্র। রাতের বেলা সে ও মতিন নদীর পাড়ে কিছুটা সময় দাঁড়িয়েছিল। একটু দূরে একটা সেতু দেখা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে দুয়েকটা গাড়ি সেতু পার হচ্ছে। এছাড়া নিস্তব্ধ চরাচর। দাহ করার কোনো শব্দও এখানে আসছে না। সন্ধ্যাবেলা মতিন ফোনে বলে, শিবুদার মা মারা গেছেন। পারবি আমার সঙ্গে জামালপুর যেতে। একমুহূর্ত সময় নেয়নি রাজি হতে।
শিবুদার বাড়ি খুঁজে পেতেই সময়টা একটু লেগেছিল। তারপর শবদেহ নিয়ে ‘বল হরি, হরি বল’ করতে করতে কত মাইল হেঁটেছিল জানে না। শিবুদা খুব স্বাভাবিক। শান্ত তো তিনি সবসময়ই। সেদিন যেন আরো শান্ত ছিলেন। তাছাড়া পরিণত বয়সে মায়ের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় বিরাশি। কাকাবাবুর বয়স প্রায় নব্বই পার। দাহ পুরো শেষ হতে অনেকটা সময় লাগে। মতিন ও সে, দুজনে, সার্কিট হাউজে রাত সাড়ে তিনটায় পৌঁছায়। মতিনের গাড়িচালক একটা রুমে, মতিন আর সে আরেকটা রুমে গিয়ে সটান শুয়ে পড়ে। দশটার দিকে মধুপুর বাজারে খেয়ে নিয়েছিল বলে রক্ষা।
সকালে উঠে গোসলটোসল সেরে নাস্তা করা, করেই ফের শিবুদার বাসায়। কাকার সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ চলে। অনেক কথা বলেন। সেই স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু করে পরের দিনগুলি বাংলাদেশে কীভাবে কী হলো কত যে কথা! মাঝখানে আশেক মাহমুদ কলেজের অধ্যক্ষ আসেন। গতকাল রাতে তারা কাকাবাবুর পাশে বসে থাকতে দেখেছিলেন। তখনই আলাপ হয়। মতিনের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিলেন। মতিন সবসময় ব্যস্ত মানুষ। যত দিন গেছে ব্যস্ততা বেড়েই চলেছে। আগে ফোন খোলা রাখলে দিনে কতগুলো ফোন আসত। কত কথা যে বলতে হতো। এখন ফোন বন্ধ রেখে রেহাই কিছুটা মিললেও, ফোন খোলা রাখা মানে একটার পর একটা ফোন আসতে থাকবে।
মন খারাপ হলে মতিনের কাছে গেলেই হলো। দিদার তাকে বলে দিয়েছিল, এই অফিসে, আপনার কোনো রকম সমস্যা হলে সোজা মতিন ভাইয়ের কাছে চলে যাবেন। সে এটা অনেক আগে থেকে জানে। মতিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। মাঝখানে অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ ছিল না। জানে না এই অফিসে এসে ভুল বা ঠিক কোনটা করল। দিদারের কারণেই এখানে আসা। দিদার বলেছে, চুপচাপ কাজ করতে থাকো। পরে দেখা যাবে কী হয়। এখনই সব পেতে হবে কেন? তাছাড়া কী পেতে চাও? তোমার জীবনে তো আমি তো দেখি কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। তার ওপর বউ মারা গেছে। বাচ্চাকাচ্চাও নেওনি। ফলে... মঞ্জিকা একেবারে দুম করে মারা গেছে বলা যাবে না। জীবনে অনেক চাপ সে নিয়েছিল। সব কিছুই নীরবে সয়ে জীবনটা বয়ে নিয়ে বলতে যা বোঝায় তাই করেছিল সে। ভেতরের প্রায় কোনো কিছু একটা সময় পর একদম বলতে চাইত না। টেরই পেতে দিত না।
২.
মঞ্জিকার সঙ্গে তখনও বিয়ে হয়নি। কী একটা কাজে সে মতিনের অফিসে গিয়েছিল। ফোন বেজে উঠলে, মোবাইল পকেট থেকে বের করে ভ্রু কুঁচকে অস্ফুটে শুধু বলেছিল- মঞ্জিকা! এই সময়ে! হ্যালো। বলে সে উঠে যায়। মতিনের কক্ষের বাইরে একটা ঝুল বারান্দায় বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়। কথার বিষয় বিসিএসে মঞ্জিকার চাকরিটা অবশেষে হলো। সে খুব খুশি মুখে ঘরে ঢুকলে এটা যেন কোনো কিছুর নামই হতে পারে না এমন ভ্রুকুটি করে মতিন জানতে চাইল, মঞ্জিকা মানে! মঞ্জিকা কী? সে সঙ্গে সঙ্গে বলে, একটা দোকানের নাম। কেন? নামটা কেমন না! কেমন মানে? তুই বাংলা অভিধান দেখে নিস। অভিধানে সে এই শব্দটি পায়নি বলে নয়, বাসায় তার কাছে কোনো বাংলা অভিধান নেই। মতিন এই নিয়ে বলেছিল, এই অফিসে কাজ করতে এসেছ। অন্তত দশ-বারোটা না হলে তিন-চারটা অভিধান তো রাখতে হবে। আমার নামে অর্ধেক দামে নিয়ে নিস। টাকা না থাকলে ধার নিস।
মতিন সবসময় বলত, অভিধান হলো পড়ালেখার চোখ। অভিধান ছাড়া পড়ালেখা হলো অন্ধের পড়ালেখা। পশ্চিমারা যে যে কারণে এগিয়ে গেল, তার একটা হলো এই অভিধান তৈরি। কত রকমারি অভিধান আর এনসাইক্লোপিডিয়া তাদের এগিয়ে নিয়ে গেল- আমরা এখনও বুঝতে পারিনি। মতিনের কাছে জেমস মারের গল্পটা শুনেছিল। নিজের প্রত্যঙ্গ কেটে বাদ দিয়েছিলেন যাতে কোনোরকমের আসঙ্গলিপ্সা অভিধান তৈরির কাজে এতটুকু যেন নাক না গলাতে পারে।
মতিনের একটা কথা একদিন খুব ভালো লেগেছিল। বলেছিল, জীবন কারো কারো উঁচু জমি। কারো কারো কাছে নিচু জমি। নিচু জমিতে এক মৌসুমে জল তো আরেক মৌসুমে ফসল। হাওর এলাকা যেমন। কিছু কিছু এলাকায় এমন বড় না হলেও অল্প এলাকাজুড়ে নিচু জমি আছে- ‘ডহর’ বলে কোথাও কোথাও। আমরা ছোট মানুষরা হলাম ডহর। বড় মানুষরা হলো হাওর। মাগার জল আর ফসলের পালায় কারো রেহাই নেই। জীবন ডহর হবে না কি হাওর হবে, না কি পাহাড় হবে- কে ঠিক করবে? তুই তোরটা ঠিক করবি। আমি আমারটা ঠিক করব। আর কেউ ঠিক করে দিতে চাইলে উল্টাপাল্টা করবে, ঝামেলা করবে।
মতিন অনেক কিছুর জন্য শিবুদার কাছে যায়। আমরা তিন জনই এগ্রিকালচারে তিন ব্যাচে পড়েছি। শিবুদা আমার চেয়ে তিন ব্যাচ আর মতিনের চেয়ে দুই ব্যাচ সিনিয়র। শিবুদা পাস করেই নিজের বিভাগে যোগ দেন কয়েক বছর পর। বাসা বইপত্রপত্রিকায় ঠাসা। ষাট সাল থেকে ‘দেশ’ পত্রিকার সব সংখ্যা যেমন আছে, তেমন আছে ‘অনুষ্টুপ’, ‘বিজ্ঞাপনপর্ব’, ‘কবিতীর্থ’, ‘জারি বোবা যুদ্ধে’র প্রায় সব সংখ্যা। শিবুদার বড় ভাই দেবনাথ আচার্য কলেজে বাংলা পড়ান। ‘বৈতালিক’ নামে ছোট কাগজ করেন। শিবুদা মতিন আর তাকে দেখিয়েছিল। শিবনাথ আচার্য দেবনাথ আচার্যের ছোটভাই বা রমানাথ আচার্যের ছেলে বলে নয়, নিজেও প্রচুর পড়ালেখা করতেন। নিজের বিষয়ের বাইরে রাজ্যের জানাশোনার কৌতূহল তার সব কালে অটুট। বাবা রমানাথ আচার্য দীর্ঘদিন একটা স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন।
জামালপুর শহরটা ছোট। সবাই একনামে তাঁকে চেনেন। সবারই খুব নমস্য মানুষ। একমাথা সাদাচুল। মাঝারি আকৃতির টকটকে ফর্সা। শিবুদা তত ফর্সা নন। এখন কাজ করছেন বাংলায় একটা কৃষি অভিধান নিয়ে। এটা হলে কৃষিবিষয়ে শিক্ষাটা নতুন মাত্রা পাবে বলে মতিন মনে করে। মতিন হলো অভিধানের ভাণ্ডারি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর অভিধানের জগতে ঢুকে পড়ে মতিন। নিজে কয়েকটা কাজ করেছে। সেই সূত্রেই এই অফিসে তার চাকরিটা হয়। তাও প্রায় দশ বছর হতে চলল। মতিনের কাছে এখন হাজার না হলেও শত শত বিচিত্র বিষয়ে অভিধান। শিবুদার মতে, নিজের বাড়ি আছে ঢাকার মতো জায়গায়- আর কী চাই। আজিমপুরে চায়নাবিল্ডিংয়ের গলিতে বিরাট বাড়ি। পুরোনো আমলের। দাদা করেছিল বাড়ি। বাপে বাকিটা। মতিন একদম চাপহীন মানুষ। মতিনের দুঃখ আছে কিনা জানে না। কেবল জানে মতিন অনেকদিন বিয়ে করলেও ছেলেমেয়ে হয়নি। এই নিয়ে মতিনকে কোনোদিন কথা বলতে শোনেনি।
মতিন নিজে অনেক কিছু করেছে। ঢাকায় নিজের বাড়ি থাকলে এমন ঝুঁকি ধুমসে নেওয়া যায়- শিবুদা মজা করে বলেন। মতিন প্রথমে শুরু করেছিল বিনোদন সাংবাদিকতা দিয়ে। সেই সূত্রে দারুণ সুন্দরী, একসময় মডেল হতে চাওয়া নওরিন ফেরদৌসীর সঙ্গে আলাপ হয়। বিয়ের পর মতিন রাতারাতি বদলে যেতে শুরু করে। সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে বছরদুয়েক এনজিওতে কাজ করে, পরে এই অফিসে এসে থিতু হয়। এখন একদম গোছানো জীবন। কোনো কিছুর অভাব নেই। অভিযোগ নেই। কারো নামে বদনাম দুর্নাম পর্যন্ত মতিন করে না। একদিন তাকে বললে, তিনি বলেন, তুইও তো এখন একদম মুখে তালা দিয়েছিস। প্রয়োজনীয় কথাটাও তো বলিস না। মঞ্জিকার মৃত্যুটা তাকে এমন করেছে, তা ঠিক নয়। কিন্তু বেশিরভাগই ধরে নিয়েছে এমনটা করছে মঞ্জিকা না থাকার জন্য। মতিনকে সে বলতে পারেনি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, ‘মরণসাগরপারে/ তোমরা অমর/ তোমাদের স্মরি।’ শহীদদের তালিকার নিচে থাকা কথা নিয়ে একদিন বিকালে হঠাৎ সে অনেক ভেবেছিল। মরে গেলে কী হবে? অমর কি হওয়া যায়? কে কাদের কেন মনে রাখে?- এমন অনেক কথা ঘুরপাক খেয়েছিল।
তখন কেবল সব পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কদিন পর চলে যেতে হবে। কীসের জন্য বুকের ভেতরটা বারবার হু হু করে ওঠে- বুঝতে পারছিল না। এখানে এসেছিল ঝোঁকের বশে। এই বিষয়টাই যে পড়তে চেয়েছিল তা তো নয়। তবে সে পড়ুয়া ছিল। এজন্য সে বেঁচে গেছে। ইকরাম স্যারের কথা, বিশ্ববিদ্যালয় হলো পড়ুয়া ছাত্রদের জন্য। যারা চাকরির জন্য, সনদপত্র নেওয়ার জন্য এসেছ, তারা স্রেফ পাঁচটা বছর নষ্ট করতে এসেছ। জীবন এত ছোট যে, এই পাঁচটা বছর অন্য কাজে লাগানো দরকার তাদের। অবশ্য এসব বলে আর কী!
কিন্তু জীবন কীসের জন্য? সে বুঝতে পারছিল না। কোনোদিন ভাবেনি- কেন জীবন? কীসের জন্য জীবন? ঠিক তখন শিবুদার কাছে গিয়েছিল। শিবুদা অদ্ভুত একটা কথা বলেছিলেন, এক সময় মানুষ পায়ে হেঁটে যেত। পরে চাকা তৈরি করল। তারপর মানুষ উড়তে শিখল। কোনো কিছুই তো একদিনে বা হুট করে হয়নি। মানুষের ইতিহাসে যেমন এইরকম হাঁটাপর্ব, চাকাপর্ব ও উড়োজাহাজ পর্ব থাকে, প্রতিটা মানুষের জীবনেও থাকে। এর ভেতরে চাকাপর্বটা হলো সবচেয়ে খেয়াল করার। নিজেকে একটা বৃত্তে নিতে হবে। বা নিজেই কোনো একটা বৃত্ত তৈরি করতে হবে। তারপর জীবনের রাস্তায় সেটা গড়িয়ে দিতে হবে। ব্যাস। এর বেশি আমাদের মতো মানুষ আর কী করতে পারো বলো?
কিন্তু তার জীবন তো অবিরাম বৃত্ত তৈরির নয়, বৃত্ত ভাঙার জীবন। ছোটবেলায় মাদ্রাসায় পড়েছে। পরে হাই স্কুলে। ছিল গহীন গ্রামে, পরে শহরে। কোনো একটা জায়গায় সে স্থির হতে পারেনি। কোনো একটা বিশ্বাসও তার ভেতরে গেঁড়ে বসতে পারেনি। মতিন জিজ্ঞাসা করেছিল, তোর কোনো পলিটিক্যাল আইডিওলজি আছে? কোনো পলিটিক্যাল আইডিওলজিতে আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আবার আমি একদম কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করি না তা তো নয়। আমি রোজার সময় রোজা রাখি, শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়তে যাই। হয়ত কোনো দিন হজেও যাবো। কিন্তু রাজনীতি মানে একটা দেশ কী রাজনীতিতে চলবে, কেন চলবে- এসব নিয়ে আমি তো তেমন ভাবিনি। কোনো পার্টিকেও সমর্থন করতে পারিনি। আমি মনে হয়, একদমই অ্যাপলিটিক্যাল ম্যান। কে জানে এটাই আমার পলিটিক্স নাকি!
বাব্বা, তুই এত কথা বলতে পারিস, আগে জানতাম না। তোকে তো মাঝে মাঝে ফুঁ দিতে হবে। তাহলেই বেজে উঠবি। মতিনের এ মন্তব্যে সে কোনো কথা বলেনি। কথাগুলো বলে তার বরং অস্বস্তি হয়েছে। নিজে যেচে কোনো দিন কোনো কথা বলার দরকার নেই- এটাই মানুষের টিকে থাকার এক নম্বর নিয়ম হওয়া দরকার। কেবল নিজের দরকারে কিছু জিজ্ঞাসা করা ছাড়া কোনো প্রশ্ন থাকার দরকার নেই।
৩.
সে অনেক খেয়াল করে দেখেছে, ঠিক তিন মাসের বেশি তার কোনো কিছু ভালো লাগে না। সে-ই তারই কাছে মঞ্জিকাকে কখনো পুরোনো-ফুরোনো মনে হয়নি। মঞ্জিকা তাকে নিয়ে দারুণই তো ছিল! মঞ্জিকা খুবই চাপা মেয়ে ছিল। নিজের পরিবারের একটার পর একটা ঝামেলা আর সরকারি চাকরি করলেও সেখানে অফিসের ভেতরের রাজনীতিতে কেন সে জড়াতে গেল! মঞ্জিকা বলত, তার প্রিয় খেলা ছিল দাবা। জীবনেও চালের পর চাল দিয়ে চলেছে। একমাত্র তুমি আমার জীবনে কোনো চাল ছিলে না। আমি খুব ভেবে বা একেবারেই না ভেবে কোনোটা করেই তোমার সঙ্গে জুড়ে যাইনি। আমার জীবনে একবারই ইন্সটিঙ্ক কাজ করেছিল, বা আমি সেটার ওপর ভরসা করেছিলাম, আর সেটা হলো তুমি। তুমি কথা কম বলো, ঝগড়া করার মানুষ তুমি নও। একদম চুপচাপ; অন্য কারো বেলায় হলে আমি এটা পছন্দ করতাম কি না কে জানে, তোমার বেলা ওসব কাজই করল না।
সে কেন এমন হলো ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারে না। শিবুদা বিশ্ববিদ্যালয় পাস করার পর লিটন স্ট্র্যাচির ‘এমিনেন্ট ভিক্টোরিয়ান্স’ আর লিটন স্ট্র্যাচির বিশাল সেই জীবনীটা পড়তে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, একটু ভিন্ন কিছু পড়ে দেখতে পারো। মতিন বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই বলেছিল, পড়ুয়া তুই/ ভেড়ুয়া হয়ে যাসনে! স্ট্র্যাচির জীবনীটা পুরো শেষ করা হয়নি। ‘এমিনেন্ট ভিক্টোরিয়ান্সে’র শেষ লেখাটা শুধু পড়া হয়নি। শিবুদা বই দুটো দরকারে চেয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। শিবুদা বই পড়তে দিতেন, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময় পর সেগুলো চেয়ে নিয়ে যেতেন। মতিনের মতে, বই দিয়ে ফেরত নেওয়ার এই কাজটা যে পারে তার দ্বারা অনেক কিছুই সম্ভব। শিবুদা কদিন পর নেদারল্যান্ডস যাবেন। দারুণ একটা বৃত্তি পেয়েছেন!
শিবুদা চলে গেলে আমার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকাটা কঠিন হবে কি? মতিন হঠাৎ বলেছিল। শিবুদাকে এসব জিজ্ঞাসা করা যায় না। কাউকেই করা যায় না। জীবন যার যার, তার তার লড়াই। শিবুদা বলতেন, জীবন যার যার, তার তার গেরিলা যুদ্ধ। মঞ্জিকাকে ওর কোনো কোনো বন্ধু ‘গঞ্জিকা’ বলে খ্যাপাত। মঞ্জিকা নিজেও পুরোনো বন্ধুদের ফোন করে বলত- গঞ্জিকা বলছি। বলেই খুব হাসত। কী নির্মল সুন্দর হাসিই না সে হাসতে পারত। অথচ কী যেন একটা অবসাদে পেয়ে গেল!
আসল বিষয়টি কী! তাদের একসঙ্গে জীবন শুরু করার পরপর জরায়ুতে সমস্যার কারণে জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়। এসব নিয়ে সে মঞ্জিকাকে কোনোদিন একটা টুঁ শব্দও করেনি। তার ছেলেমেয়ে বাচ্চাকাচ্চা বিষয়টা একদমই পছন্দ ছিল না। এটা হওয়ায় মনে মনে স্বস্তিই বরং পেয়েছিল। অনেকদিন বেশ ভালোই ছিল মঞ্জিকা। তারপর হঠাৎ বদল হতে শুরু করল। শরীর ভেঙে পড়ল। সে বারবার বলেছিল, একটু বিশ্রাম নিতে। দেশের বাইরে কিছুদিন ঘুরে আসার কথাও বলেছিল। দেশের বাইরে মানে ভারতে বা মালয়েশিয়ায় বা সিঙ্গপুরে থাইল্যান্ডে। বৌদের ঘোরার বাতিক থাকলে স্বামীদের অনেক দেশ ঘোরা হয়।
মতিনের ও তার দুজনেরই বাচ্চাকাচ্চা নেই। তারা ধুমসে দেশবিদেশ ঘুরতে পারত। কিন্তু মতিন সারাদিন অভিধানে ডুবে থাকে। এটা এক আজব নেশা। একটা পুরো বুক শেল্ফ ভরে আছে অভিধান। হঠাৎ কী মনে করে একদিন মতিনের বাসায়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাশের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’ দ্বিতীয় খণ্ডটা খুলে মঞ্জিকা শব্দটা খোঁজে। পেতে দেরি হয় না। একটাই অর্থ লেখা। চোখের সামনে ওই জায়গাটা আগুন জ্বলে ওঠে: বারাঙ্গনা। কিছুক্ষণ জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে থেকে সে আস্তে করে অভিধানটা বন্ধ করে একটা টুলে বসে পড়ে। মতিন একগাদা প্লাস্টিকের টুল কিনেছে। বেতের মতো বুনন বলেই নাম: কেইন টুল-হাই। তার পড়ার ঘরের একটা জায়গায় তিনটা; একটার ওপরে আরেকটা চাপানো। মতিনের দেখাদেখি সেও কয়েকটা কিনেছে। টুলে বসে পড়েই মঞ্জিকার অনেক পুরোনো একটা কথা মনে পড়ে; তখন তাদের কেবল সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল।
আমার একটা অন্ধকার অতীত আছে। সেটা হলো... শুনেই সে বলে, আমি জানতে চাই না। পরে অন্যের কাছে শুনে তুমি কিন্তু আমাকে দোষী... কারো কাছেই শুনতে চাই না। কিন্তু তোমার জানা ভালো। তোমার মনে হচ্ছে আমার জানা ভালো, কিন্তু তাতে তোমার জন্য যদি খারাপ হয়... আমি তো সেই সব ভালো-মন্দ পার হয়ে এসেছি। আচ্ছা বলো।
মঞ্জিকা প্রথমে ছোট্ট করে ইংরেজিতে বলে, আই ওয়াজ রেপড। তখন আমার বয়স মাত্র চৌদ্দ বছর। এখনকার মতোই স্বাস্থ্য ভালো ছিল। একটু বেশিই ভালো ছিল। আমার এক চাচাত ভাই ও তার বন্ধুরা একদিন সবাই মিলে... আমি বলে খুব খোলামেলা পোষাক পরতাম- এর দোষেই নাকি... ওদের পাঁচটাকে ভয়াবহ পেটানো হয়েছিল। এলাকার লোকজন ঘেন্না করত। পরে ওরা এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কারণ আমাদের পরিবারে তুমি জানো মামা পুলিশের এস.পি, চাচা কর্নেল, বোনের জামাই রাজনীতিবিদ, এক খালু ক্ষমতাধর আমলা, এক খালাত ভাই সাংবাদিক, মেজ ভাই তখন কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছে- ফলে সব আছে। ওরা এগুলো হিসাব করে দেখেনি। সে আর কিছু শুনতে পাচ্ছিল না। কিন্তু তার ভেতরে কী এক মহান মানুষ জেগে ওঠে- সে বলে, থাক। এসব শুনে কোনো লাভ নেই।
একবার শুধু মঞ্জিকার দিকে তাকিয়ে দেখে। না, সে স্বাভাবিক আছে। অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়ত হাপুস নয়নে কেঁদে বুক ভাসিয়ে বলত। ফতুয়া জিনস পরা, মাথায় চুল চূড়া বাঁধা মঞ্জিকাকে সেদিনের পর থেকে আরো ভালো লাগতে শুরু করে।
৪.
নেয়ামুল তাকে সাকুরায় নিয়ে মদ খেতে খেতে নিজের স্ত্রীর অবিশ্বস্ততার গল্প শোনায়। দিনের পর দিন সে এটা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাকে ডিভোর্স দিচ্ছে না। নেয়ামুল কয়েকটা গার্মেন্টসের মালিক। এত অল্প বয়সে পুরো নিজের চেষ্টায় নড়াইলের গ্রামের ছেলে ঢাকায় এসে, বুঝলি সাকসেস আর সাকসেস... আর এই হলো আমার সাকসেসের নমুনা। সে বলতে পারেনি, কেন নায়িকা এই মেয়েকে নেয়ামুল বিয়ে করতে গেল! দেশে আর মেয়ে ছিল না? নেয়ামুলের বৌ লিরিল সব দিক থেকে এ ক্লাস! ডেন্টাল কলেজ থেকে পাস করেছে। দেখতে ভয়াবহ আকর্ষণীয়া। শুরু থেকেই একটা ছবিও হিট হয়নি। হাল ছাড়েনি লিরিল। তাসনিয়া লিরিল। মেয়েটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা জোরদার করতে প্রডিউসারের কোলে কোলে ঘুরে বেড়াত। এখন ওটিটিতে ওর ভয়াবহ চাহিদা। সব খুল্লামখুল্লো দশায় ফাটিয়ে দিচ্ছে। নতুন ইন্ডাস্ট্রিতে সুপার বিজি সুপার হিট। আর আমি আমার ইন্ডাস্ট্রিতে সুপার বিজি। আর বেশ চলছে আমাদের কী বলিস?
লিরিল আর নেয়ামুলের একটা ছেলে। দার্জিলিংয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। একটা দুটো ছেলেমেয়ে কিন্তু হোস্টেলে রাখিয়ে পড়ে, এমন স্বামী-স্ত্রীদের প্রায় সবারই এই কেস আছে। বুঝলি কিছু? কদিন আগে একটা ইন্টারভিউ দেখলাম কোন কাগজে। সেখানে নামটা সংক্ষেপে হয়েছে- তা.লি.! দারুণ না! ফাটিয়ে দিচ্ছে বউ আমার। সে সাধারণ নেয়ামুলের ফোন দেখলেই ভয় পেত। যদিও গাড়ি করে নিয়ে, ফের যত রাতই হোক বাড়ি পৌঁছে দিত। মদ খেতে খেতে বারবারই বলত, তোর তো বাসায় বউ নাই। বউ মরে গেছে! শালা! ভাগ্যবানের জরু মরে, অভাগার মরে গরু। গরু ইজ বেটার দেন জরু। এই শালা তুই থাকিস কীভাবে! তোর জাগে টাগে না! আমরা তো শালা ওপেন রিলেশানশিপে চলে গেছি। সেও ঠাপিয়ে বেড়াচ্ছে, আমিই-বা বসে থাকব কেন? ছেলেটা দূরে আছে! সে পাহাড়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে! প্রচণ্ড শব্দে হেসে ওঠে। গলায় পুরোটা ঢেলে টেবিলে সশব্দে গ্লাসটা রেখে দাঁতে দাঁত ঘষে বলে- শালা!
সে বলতে পারল না যে লিরিলকে তার খুবই ভালো লেগেছিল। এত ভদ্র মার্জিত বিনয়ী ব্যবহার। কোনো ঠাট নেই। কোনো দেমাগ নেই। টিভিতেও একদিন সিনেমা নিয়ে টকশোতে দেখল কী সহজ হাসিখুশি মনখোলা কথাবার্তা। সমস্যা নেয়ামুলেরই বেশি। নেয়ামুল অনেক আগে থেকে স্বভাব খারাপ। টাকা ও মেয়েমানুষ- চেনার মধ্যে এই দুই কীভাবে কব্জা করতে হয় শিখেছে। প্রায় ছ’ফুট লম্বা। ডার্ক বোল্ড হ্যান্ডসাম বলতে যা বোঝায়। সবার ভেতরে আলাদা করে নেয়ামুলকে চোখে না পড়ে উপায় নেই। লিরিল আর নেয়ামুল পাশাপাশি দাঁড়ালে একেবারে রাজজোটক। সোনায় সোহাগা।
বাসায় ফিরতে ফিরতে বারোটা বেজেছে। পরের দিন ছুটি। নেয়ামুল বারবার বলছিল, আগামীকাল ফ্রাইডে। ফলে আজকে সাধ মিটিয়ে নিই। এই লোককে এমনি দেখলে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই, এর দাম্পত্যে আগুন লেগেছে, এত মদ খেতে পারে! পুরোটা মুখোশে ঢাকা। লিরিল সম্পর্কে যা বলে, সেসব অনেকটাই বানানো। নইলে লিরিল ছাড়ে না কেন? তাছাড়া খাচ্ছে দাচ্ছে ধুমসে টাকা কামাচ্ছে, দেশবিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে- মৌজমাস্তিতে জীবন ভরপুর। সে তো মনে করে তার জীবনের কোনো গতিপথ নেই। কোনো মানেই পাচ্ছে না সে। কী করবে সামনে? এই চাকরিটাই চালিয়ে যাবে? নতুন কোনো সম্পর্কে জড়াবে! বংশধর রেখে যাবে? বয়স তো তার বেশি নয়। আর পুরুষ মানুষের তো বয়স কোনো সমস্যা না। নেয়ামুল বলে, তোকেও একটা সিনেমার মাল ধরিয়ে দিই। ঘরে বাইরে সব জায়গায় তোর সিনেমা শুরু হয়ে যাক- কী বলিস? শালা!
পরদিন সকালে উঠেই সে মহাখালী চলে আসে। মাঝে সে কোথাও নামেনি। জানালার পাশে সিট পেয়েছিল। যেতে যেতে মনে হচ্ছিল, শিবুদার জীবন একরকম, মতিনের আরেক রকম, নেয়ামুলের অন্যরকম, কিন্তু সবার জীবনেই একটা গতি আছে। তার জীবনে কি গতি আছে? মতিন বলেছিল, শান্তির চেয়ে গতি বেশি দরকার। যখন তুই স্পিডে থাকবি তখন কী ঘটে জানিস তো! না জানলে জেনে যাবি- গতি ও দুর্গতি ফিফটি ফিফটি চান্স। লাইফে একটা গতি আন। হাইস্পিড গতি।
না, কোনো গতি বা দুর্গতির ভেতরেই সে পড়তে চায় না। জীবন কখনো জলে, কখলো ফলে-ফসলে। সব সময় তো আর দিনের আলো থাকে না। আবার এমন না যে রাতের অন্ধকার কোনো মতেই যায় না। মনের বেলায় হুবহু একই রকম যে ঘটে, তাও তো নয়। আজকে তার মন ভালো হওয়াটা শুধু দরকার ছিল। এখন সেটাকেও আর দরকারি মনে হচ্ছে না।