এক হাতে হাতুড়ি, আরেক হাতে কাস্তে। ওপরে টাঙ্গানো লাল পতাকা। এমনই একটি স্মৃতি স্তম্ভেব পেছনে পরিত্যক্ত ১৮ শতাংশ ভূমি। বর্তমানে দেখতে ছিমছাম পরিত্যক্ত জায়গাটিতে দশ বছর আগে ছিল রানা প্লাজা নামের নয় তলা ভবন। ভবনে ছিল কয়েকটি পোশাক কারখানা। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের সকালে ভবনের কারখানায় কাজ শুরু করেছিলেন শ্রমিকরা। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিকট শব্দে ধসে পড়ে পুরো ভবন। সৃষ্টি হয় এক নির্মম ইতিহাস। প্রাণ হারান ১১৩৬ জন শ্রমিক। সে ঘটনার ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনও সেদিনের স্মৃতি বহন করছেন অনেকেই। সেদিনের ঘটনার পর অনেকের জীবন কাটছে জীবন্ত লাশ হয়ে। সেদিনের ‘ক্ষত’ এখনও দগদগে তাদের হৃদয়ে।
ফিরে দেখা ২৪ এপ্রিল ২০১৩: ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ছিল রানা প্লাজা। ভবনের প্রথম তলায় ছিল বিভিন্ন দোকান। দ্বিতীয় তলায় দোকান ও ব্যাংকের শাখা। তৃতীয় থেকে সপ্তম তলাতে ছিল পোশাক কারখানা। এরমধ্যে তৃতীয় তলায় নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেডে এবং ফ্যানটম ট্যাক লিমিটেড, ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায় ইথারটেক্স লিমিটেড গার্মেন্টস। অষ্টম ও নবম তলা ছিল ফাঁকা।
সেদিন সকালে ভবনে কাজ করছিলেন প্রায় ৩,০০০ শ্রমিক। সকাল ৮টার দিকেই কর্মব্যস্ততা শুরু হয়েছিল ভবনটিতে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিকট শব্দে প্রথম তলার ওপরে পুরো ভবন ধসে পড়ে।
এর পরপরই শুরু হয় উদ্ধার কাজ। শুরুতে এগিয়ে আসেন স্থানীয় লোকজনরা। দ্রুত সময়ে উদ্ধার কাজে যোগ দেয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, আনসার, র্যাব ও পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার উদ্ধারকারীরা।
এমন ইতিহাসের জন্ম নাও হতে পারতো: ২৪ এপ্রিল ধসের একদিন আগেই ওই ভবনের চার ও পাঁচ তলার কয়েকটি পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছিল। এ কারণে শ্রমিকরা সড়কে নেমে আসেন। খবর পেয়ে স্থানীয় সংবাদকর্মীরা সেখানে যান। তবে মালিকপক্ষ সংবাদকর্মীদের ভবনে প্রবেশ করতে দেয়নি। তারা যোগাযোগ করেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বিষয়টি নিয়ে খবর প্রকাশ হয় সংবাদমাধ্যম।
ওইদিন বিকেলের দিকে ওই সময়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন সরদার ভবনের ফাটল পরিদর্শন করেন। এরপর ব্যবসায়ী ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের তিনি বলেন, “এ ফাটলে তেমন কোনো সমস্যা নেই, বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নেই। সামান্য প্লাস্টার উঠে গেছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।” এরপর ইউএনও চলে যান।
এর কয়েকঘণ্টা পরেই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভবন ধসের সাক্ষী হয় বাংলাদেশসহ সাড়া বিশ্ব। প্রাণ হারায় হাজারো শ্রমিক। ওই ঘটনার পরেই ওই ইউএনওকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আহত শ্রমিক, শ্রমিক নেতা ও সুশীল সমাজের দাবি, প্রশাসন যথাযথ তৎপরতা রাখলে হয়তো এমন ঘটনা এড়ানো যেতো।
অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন ও মৃত লাশের গন্ধের সাক্ষী অধরচন্দ্র স্কুল মাঠ: ২৪ এপ্রিল ভবন ধসে পড়ার পরপরই রানা প্লাজা থেকে একে একে উদ্ধার হতে থাকে জীবিত, আহত, মৃত মানুষের দেহ। আহতদের নেওয়া হয় আশপাশের হাসপাতালে। আর মৃতদের দেহ নেওয়া হয় সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে।
অধরচন্দ্র স্কুল মাঠ
টানা ১৭ দিন ধরে চলা অভিযানে উদ্ধার হওয়া প্রতিটি মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে নেওয়া হতো ওই মাঠে। লাশের অপেক্ষায় থাকা স্বজনরা ছুটে আসতেন সাইরেন শুনলেই। এই বুঝি স্বজনের মরদেহ এলো! স্বজনদের আহাজারিতে দিনরাত ভারি হয়ে থাকতো অধরচন্দ্র স্কুল মাঠ।
প্রায় দেড় কিলোমিটার সড়কের পুরোটা জুড়েই তখন কান্না আর সাইরেনের আওয়াজ। অধরচন্দ্রের ওই মাঠ এখনও বয়ে বেড়ায় সেই স্মৃতি।
ওই সময় স্কুলটিতে পড়তেন আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, ‘আগে ক্লাসের বাইরেও প্রচুর ঘুরাফেরা, খেলাধুলা করতাম এই মাঠে। কিন্তু রানা প্লাজার ধসে পড়ার পর লাশ সারি করে রাখা হয়েছিল এখানে। এখনও গা ছমছম করে ওঠে সেদিনের কথা মনে পড়লে।’
হতাহত যত: প্রায় ১৭ দিনের উদ্ধার অভিযানে রানা প্লাজার ভবন থেকে ১,১৩৬ জন শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল ২,৪৩৮ জন শ্রমিককে।
আহতদের অনেকেই এখনও দুর্বিষহ সেইদিনের স্মৃতি বয়ে বেরাচ্ছেন। অনেকেই অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু। এখনও সেদিনের স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় তাদের।
হতাহত শ্রমিকের স্মৃতিতে নির্মিত শহিদ বেদী এখন ‘প্রতিবাদের প্রতীক’: হতভাগ্য শ্রমিকদের স্মরণে ২০১৩ সালের ২৪ মে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের সামনে একটি শহিদ বেদী নির্মাণ করেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। অস্থায়ী এই শহিদ বেদীটির নামকরণ করা হয় ‘প্রতিবাদ-প্রতিরোধ।’
এই বেদিটিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন চালিয়ে আসছে নানা আন্দোলনের কর্মসূচি। এটি এখন শ্রমিকদের কাছে হয়ে উঠেছে ‘প্রতিবাদের প্রতীক।’
এখন যেমন আছে রানা প্লাজার সেই স্থান: ধসের পরপরই প্রায় সব ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এরপর জমিটির চারপাশ কাটাতার ও টিনের বেড়া দিয়ে রাখা হয়েছিল। ওই সময় প্রায় প্রতিদিনই রানা প্লাজায় আহত, নিহত আর নিখোঁজ স্বজনরা জায়গাটিতে আসতেন। তবে ধীরে ধীরে জায়গাটি পরিণত হয় পরিত্যক্ত ভূমিতে।
বর্তমানে জায়গাটিতে নানা লতাপাতার দখল। সামনে বেদী। ফুটপাত জুড়ে রাখা থাকে রেন্ট-এ কারের গাড়ি। তবে ২৪ এপ্রিল এলে নানা কর্মসূচিতে কিছুটা প্রাণ পায় জায়গাটি।
বিচার পাননি হতভাগ্যরা: রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। এরমধ্যে শ্রমিকদের মৃত্যুতে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে মামলা করে পুলিশ। ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে অপর মামলাটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আর ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে আরেকটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তিনটি মামলার কোনোটিই এখনো শেষ হয়নি। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আইনে দায়ের করা মামলাটি দীর্ঘদিন হাইকোর্টে স্থগিত হয়ে আছে। এটি বর্তমানে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন। ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগে পুলিশের করা মামলাটি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। আর ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
বাঁচার লড়াই করছেন আহতরা: প্রায় ১০ বছর ধরেই পঙ্গুত্ব নিয়ে এখনও বাঁচার লড়াই করছেন অনেকেই। অসুস্থতা আর দারিদ্রতা নিয়ে দীর্ঘ দিন বসবাস করলেও কেউ তাদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ শ্রমিকদের। শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ দোষীদের শাস্তি ও শ্রমিকদের পুনর্বাসনের দাবি করে আসছেন এতদিন।
রানা প্লাজার আহত শ্রমিক তাসলিমা বেগম বলেন, ‘মেরুদণ্ড ও পায়ে আঘাত পাইছি আমি। এতবছর ধরে কাজ করতে পারি না। অনেক কষ্টে পরিবার নিয়ে আছি। রানা প্লাজা ধসের এতদিন হয়ে গেছে আমাদের কেউ খবর নেয় নাই। আমরা কারও কাছে ভিক্ষা চাই না। আমাদের ন্যায্য পাওনা বুঝায় দেওয়া হোক।’
তাসলিমা বেগম
রানা প্লাজার একটি কারখানার সুইং অপারেটর নীলুফা বেগম ধসে পড়ার ঘটনায় মারত্মক আহত হন। ১০ বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন পায়ের ক্ষত। সুচিকিৎসার অভাবে কষ্টে আছেন তিনি।
নীলুফা বেগম বলেন, ‘রানাপ্লাজা ধসে পড়ার ১০ বছর হয়ে যায় তারপরও আমাদের কোনো খোঁজ কেউ নেয় না। আমার একটা পা মারাত্মকভাবে আহত হয় ওই ঘটনায়। ১১টা অপারেশন করা লাগছে পায়ে। পা কেটে ফেলার জন্য অনেক জায়গায় গেছি। শেষ একটা অপারেশন আছে যার জন্য ৭ লাখ টাকা লাগবে। অপারেশনের আগে ৪ লাখ টাকা জমা দেয়া লাগবে। কিন্তু ওই টাকা আমি কই পাব? আমি ক্ষতিপূরণ পাইছি মাত্র ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এটা কি কোনো ক্ষতিপূরণ হতে পারে? আজ পর্যন্ত বায়ার, মালিক কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কোন খোঁজ খবর কেউ রাখেনি। বিনা চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত ১৩ জন মারা গেছেন।’
আক্ষেপ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমিতো কোন কর্ম করতে পারি না। আমি একটা পান-সিগারেটের দোকান চালাই। এটা দিয়ে ঘরভাড়া, খাওয়া সবই করতে হয়। রানা প্লাজা ভাঙ্গার পর আমি স্বামী হারাইছি। আমার চিন্তায় মাও স্ট্রোক করে মারা গেছেন। ছেলে নতুন কাপড় কেনার জন্য টাকা চাইছে। কিন্তু কিভাবে দিব আমি? ছেলেটাকে পড়াতেও পারি নাই।’
যা বলছেন শ্রমিক নেতারা: রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর প্রায় প্রতিটি শ্রমিক সংগঠনই নড়েচড়ে বসে। শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ নিরাপদ রাখতে আন্দোলন শুরু করে সংগঠনগুলো। নিহত ও আহতদের লস অব আর্নিং-এর ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিও করেন তারা। ২৪ এপ্রিলকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করার জোর দাবি তোলেন সংগঠনের নেতারা।
বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি অরবিন্দু বেপারী বলেন, ‘রানা প্লাজার ধসে এত শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ভাবে দোষী ভবন মালিক সোহেল রানা। সম্প্রতি তার জামিন দিয়ে আবার স্থগিত করেছে আদালত। এই রাষ্ট্রটা সম্পূর্ণ রুটে শ্রমিকদের কর্মের বিনিময়ে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু এই শ্রমিক হত্যাকারী রানা তাকে জামিন দিয়ে দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে চায় নানা মহল। জামিনের জন্য তারা নানা জায়গায় তদবির করে। তাই সরকার ও বিচারবিভাগের কাছে আমরা রানার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন বিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১০ বছরে এসেও আমাদের দাবি যেগুলো ছিলো তার কিছুই পূরণ হয়নি। চিকিৎসা আর পুণর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এবার ঈদের পরদিনেই রানা প্লাজা ধস ঘটনার দিন। অথচ আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবার গুলো মানবেতর দিন পার করছে। ঈদের আনন্দ তাদের মধ্যে নেই। তাই সরকার ও বিজিএমইএ’র প্রতি দাবি দ্রুত শ্রমিকদের কিছু সহায়তা দেওয়া হোক।’