সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) গাসিক নির্বাচনে মোট ৩৩৩ জন প্রার্থীর তথ্য বিশ্লেষণ করে এক সংবাদ সম্মেলন করেছে। সেখানে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের প্রার্থীদের বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে দেখা যায় মোট প্রার্থীর ২৯.৭৩ শতাংশই মামলার আসামি।
সোমবার (২২ মে) সকালে গাজীপুর প্রেসক্লাবে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সুজন।
সংবাদ সম্মেলনে তারা জানান, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৮ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ২ জনের (২৫%) বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা আছে। এই দুইজন হলেন- জাতীয় পার্টির এমএম নিয়াজ উদ্দিন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে অতীতে তিনটি মামলা ছিল, তবে বর্তমানে কোনো মামলা নেই। আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার মধ্যে একটি ৩০২ ধারার মামলাও ছিল।
২৪৬ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে ৮৪ জনের (৩৪.১৫%) বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা রয়েছে, ৪২ জনের (১৭.০৭%) বিরুদ্ধে অতীতে এবং ২৮ জনের (১১.৩৮) বিরুদ্ধে উভয় সময়ে মামলা ছিলো। প্রার্থীদের মধ্যে ৮ জনের বিরুদ্ধে (৩.২৫%) বর্তমানে ৩০২ ধারার মামলা রয়েছে, ৪ জনের বিরুদ্ধে অতীতে ৩০২ ধারার মামলা ছিল।
৭৯ জন সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীর মধ্যে ১৩ জনের (১৬.৪৬%) বিরুদ্ধে বর্তমানে ফৌজদারি মামলা আছে এবং ৩ জনের (৩.৮০%) বিরুদ্ধে অতীতে ফৌজদারি মামলা ছিলো। একজনের জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে ৩০২ ধারার একটি মামলা রয়েছে, তিনি হলেন সংরক্ষিত ১ নং ওয়ার্ডের।
তিনটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সর্বমোট ৩৩৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ৯৯ জনের (২৯.৭৩%) বিরুদ্ধে বর্তমানে, ৪৭ জনের (১৪.১১%) বিরুদ্ধে অতীতে এবং ২৯ জনের (৮.৭১%) বিরুদ্ধে উভয় সময়ে মামলা আছে বা ছিলো। ৩০২ ধারায় ৯ জনের (২.৭০%) বিরুদ্ধে বর্তমানে এবং ৫ জনের বিরুদ্ধে (১.৫০%) অতীতে মামলা ছিলো।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের তুলনায় এবারের নির্বাচনে মামলা সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়।
প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে জানান, ৪০.২৪ শতাংশ প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে। এদের মধ্যে ৮ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ৫ জনের (৬২.৫০%) শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর, ১ জনের (১২.৫০%) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি এবং ২ জনের (২৫%) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে। স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেছেন স্বশিক্ষিত এবং জাকের পার্টির মেয়র প্রার্থী মো. রাজু আহাম্মেদ ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আজমত উল্লা খান (এলএলএম), জাতীয় পার্টি প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন (এমএসএস), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান (তাকমিল), স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম (এমবিএ) ও মো. হারুন-অর-রশীদ (এমএ)। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি উল্লেখ করা প্রার্থী হলেন গণফ্রন্টের আতিকূল ইসলাম।
মোট ৫৭ টি সাধারণ ওয়ার্ডের ২৪৬ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে ৯২ জনের (৩৭.৪০%) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি'র নিচে, ৩৯ জনের (১৫.৮৫%) এসএসসি এবং ৪৩ জনের (১৭.৪৮%) এইচএসসি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী প্রার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ৫০ জন (২০.৩৩%) ও ২১ জন (৮.৫৪%)। ১ জন (০.৪১%) সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘর পূরণ করেননি।
মোট ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ৭৯ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে প্রায় অর্ধেকের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে ৪০ জন (৫০.৩৩%)। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী প্রার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ১২ জন (১৫.১৯%) ও ৮ জন (১০.১৩%)। অন্যদিকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস প্রার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ১০ জন (১২.৬৬%) ও ৯ জন (১১.৩৯%)।
বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, সর্বমোট ৩৩৩ জন প্রার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রার্থীর (১৮৪ জন বা ৫৫.২৬%) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি ও তার নিচে, এর মধ্যে ১৩৪ জন (৪০.২৪%) প্রার্থী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করেননি। পক্ষান্তরে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী প্রার্থীর সংখ্যা মাত্র ৯৬ জন (২৮.৮৩%)।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে স্বল্পশিক্ষিত প্রার্থীর হার কিছুটা কমেছে। ২০১৮ সালে এসএসসি ও তার নিচে ছিল ৬০.৮৬%, যা এবার ৫৫.২৬%। অপরদিকে উচ্চ শিক্ষিত (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী) প্রার্থীর হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালের ২৪.০৫% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৩ সালে হয়েছে ২৮.৮৩%। স্বল্পশিক্ষিত প্রার্থীর হার হ্রাস পাওয়া এবং উচ্চ শিক্ষিত প্রার্থীর হার বৃদ্ধি পাওয়া নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
প্রার্থীদের পেশা সংক্রান্ত তথ্য জানান, ৮ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ৩ জন (৩৭.৫০%) ব্যবসায়ী, ২ জন (২৫%) চাকুরিজীবী এবং ১ জন (১২.৫০%) আইনজীবী এবং ১ জন (১২.৫০%) গৃহ সম্পত্তি ভাড়া থেকে আয় করেন এবং ১ জন (১২.৫০%) অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। ব্যবসার সাথে যুক্ত ৩ জন প্রার্থী হলেন জাকের পার্টির মেয়র প্রার্থী মোঃ রাজু আহাম্মেদ, জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন এবং স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। চাকুরিজীবী ২ জন প্রার্থীর মধ্যে গণফ্রন্টের আতিকুল ইসলাম সাংবাদিকতা এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোঃ আজমত উল্লা খান একজন আইনজীবী। স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম গৃহ সম্পত্তির ভাড়া থেকে আয় করেন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মোঃ হারুন-অর-রশীদ একজন পেনশনভোগী সরকারি কর্মকর্তা।
২৪৬ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে সিংহভাগ (১৯২ জন বা ৭৮.০৫%) প্রার্থীর পেশাই ব্যবসা। কৃষির সাথে সম্পৃক্ত আছেন ১৩ জন (৫.২৮%) করে। আইনজীবি রয়েছেন ৭ জন (২.৮৫%)। চাকুরিজীবী আছেন ১১ জন (৪.৪৭%)। ১৬ জন (৬.৫০%) প্রার্থী অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন। ৭ জন (২.৮৫%) প্রার্থী পেশার ঘর পূরণ করেননি।
৭৯ জন সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশই (৩৯ জন বা ৪৯.৩৭%) গৃহিণী। ১২ জন (১৫.১৯%) ব্যবসার সাথে যুক্ত। আইনজীবী রয়েছেন ৬ জন (৫৭.৫৯%)। চাকুরিজীবী রয়েছেন ৭ জন (৮.৮৬%)। অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ৭ জন (৮.৮৬%)। ৭৯ জন সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে ৭ জন (৮.৮৬%) পেশার ঘর পূরণ করেননি।
তিনটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সর্বমোট ৩৩৩ জন প্রার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রার্থী (২০৭ জন বা ৬২.১৬%) ব্যবসায়ী। বিশ্লেষণে অন্যান্য নির্বাচনের মত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য লক্ষ করা যাচ্ছে।
এছাড়াও সুজন থেকে প্রার্থী ও নির্ভরশীলদের বাৎসরিক আয় সংক্রান্ত ও সম্পদের তথ্য, দায় দেনা সংক্রান্ত এবং আয়কর সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
তথ্য উপস্থাপন শেষে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস, সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলিপ কুমার, ঢাকা বিভাগের সমন্বয়ক তৌফিক জিল্লুর রহমান।
এসময় বক্তরা বলেন, নির্বাচন কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দল, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গণমাধ্যম, সচেতন নাগরিক ও ভোটারদের প্রতি স্ব স্ব অবস্থান থেকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ তথা সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার আহবান করেন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন সুজনের গাজীপুর জেলার সভাপতি অধ্যাপক আমজাত হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির, সহসভাপতি সুনিল কুমার, গাজীপুর মহানগরের সভাপতি মনিরুল ইসলাম রাজিব, সহসভাপতি ক্লান্তি সরকার প্রমুখ।