প্রধানমন্ত্রীর নামে টাঙ্গাইলে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগে। কেনা হয়েছে বিভিন্ন রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সরঞ্জামও। কিন্তু জনবলসহ নানা কারণে এখনো পুরোপুরি স্বাস্থ্য সেবা চালু করতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বাস্থ্য সেবা নিতে আসা রোগীদের।
হাসপাতালের পরিচালক জানিয়েছেন, চাহিদা অনুযায়ী জনবল চেয়ে মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় হাসপাতাল পরিচালকের কক্ষসহ ভবনের বিভিন্ন দেওয়ালের টাইলসও খুলে পড়ছে।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের পাশে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৫ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করে গণপূর্ত বিভাগ। ২০১৮ সালের শেষের দিকে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ২০২২ সালের ২২ মার্চ হাসপাতাল ভবনটি কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেয় গণপূর্ত বিভাগ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর নামে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণ হলেও এখনো পুরোপুরি স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া শুরু হয়নি। ফলে নানা ধরনের রোগের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন টাঙ্গাইলসহ আশাপাশের অঞ্চলের মানুষ। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে সঙ্কট কাটিয়ে হাসপাতালটিতে পুরোপুরি চালু করার দাবি তাদের।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত বছরের সেপ্টেম্বরে মেডিসিন বিভাগ চালু হয়। এছাড়া শিশু, ডায়েরিয়া, কার্ডিওলজি, অবস (গর্ভবতী), চক্ষু, নাক, কান, গলা, গাইনি, পোস্ট অপারেটিভ, আইসিইউ, সিসিইউ, সার্জারি, অনক্লোনজি ও অর্থপেডিক ওয়ার্ড প্রক্রিয়াধীন। দ্রুত এসব ওয়ার্ড চালু করে মানুষের সেবা দেওয়া শুরু হবে।
সূত্র আরও জানায়, গত বছরের ২১ জুন থেকে হাসপাতালের বহিঃবিভাগে মেডিসিন, শিশু, গাইনি, সার্জারী, চক্ষু, ডেন্টাল, বক্ষব্যাধি, নিউরোলজি, ইউরোলজি, মানসিক, শিশু বিকাশ কেন্দ্র, ফিজিকাল মেডিসিন, চর্ম ও যৌন, কার্ডিওলজি, নেফরোলজি, অর্থপেডিক, অনকোলজি (ক্যান্সার) সেবা চালু রয়েছে। গত বছরের শুরু থেকে বহিঃবিভাগে আলট্রাসোনগ্রাফি, ইসিজি, সিটিস্ক্যান, এক্সরেসহ বিভিন্ন পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ১০টি আইসিইউ বেড, সিসিইউ ও ১৫টি অপারেশন থিয়েটারের কাজ প্রক্রিয়াধীন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, জনবল সংকটে হাসপাতালের পুরোপুরি স্বাস্থ্য সেবা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে ৬৫ জন ডাক্তার প্রয়োজন। সেখানে আছেন ৬১ জন। ১৬৫ জন নার্সের মধ্যে ৩৯ জন নার্স আছেন। এদের মধ্যে চার জন প্রশিক্ষণে, দুই জন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে ও দুই জন ইনচার্জে দায়িত্ব পালন করছেন। ৩৭৭ জন আউটসোর্সিং জনবলের মধ্যে ৯০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া আয়া, সুইপার ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীর অভাবে হাসপাতালের ভেতর জমে থাকা ময়লা ও আবর্জনা পরিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। দুগর্ন্ধে শৌচাগারে প্রবেশও করা যায় না।
টাঙ্গাইল গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো। হাসপাতাল ভবনসহ ২৭টি ভবণের নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ২৮৪ কোটি টাকা। ১০৮ কোটি টাকার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। বাকি ১০৮ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার (৩০ মে) সরেজমিন দেখা যায়, ভবনের লিফট ও আশপাশে দেওয়ালে পানের পিক ফেলে নষ্ট করা হচ্ছে পরিবেশ। ধুলা-বালুর কারণে ভবনের বিভিন্ন গ্রিলে মরিচা পড়েছে। এছাড়াও ভবনের ১০ তলায় মেডিসিন বিভাগে নারী ও পুরুষ রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে নোংড়া পরিবেশে। হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ৮৪টি নির্ধারিত বিছানা বরাদ্দ থাকলেও অতিরিক্ত মিলে আড়াই শতাধিক রোগীকে সেবা দেওয়া হচ্ছে। রোগীর বিছানার পাশে, শৌচাগারসহ বিভিন্ন কক্ষের সামনে ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। দুর্গন্ধে শৌচাগার ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
হাসপাতালের নিচ তলা ভবনের বহিঃবিভাগের টিকিট বিক্রি হচ্ছে। সেখানে রোগীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এদের মধ্যে সদর উপজেলার বাজিতপুর এলাকার সজল হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে টাঙ্গাইলে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল করা হয়েছে। বছরের পর বছর অতিবাহিত হলেও আমরা কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছি না। ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় গিয়ে সেবা নিতে হচ্ছে। এতে অনেক সময় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আমাদের দাবি দ্রুত সময়ের মধ্যে এই হাসপাতালের সব সেবা যেন চালু করা হয়।’
বাসাইল উপজেলার কাউলজানি গ্রামের প্রবাসী হালিম মিয়া বলেন, ‘আমি চার দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি। প্রতিটি ওয়ার্ডের পাশেই ময়লা আবর্জনা জমে থাকে। কেউ পরিষ্কার করে না। আমি যখন কাতারে ছিলাম তখন দেখতাম সেখানে খুব ভোরেই হাসপাতাল পরিষ্কার করতো। কিন্তু টাঙ্গাইলে সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে হাসপাতাল নির্মাণ করছে কিন্তু অযত্মে, অবহেলায় সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
বাসাইল উপজেলার কচুটি গ্রাম থেকে আসা বানু সরকার বলেন, ‘আমার স্বামী স্ট্রোক করেছেন। তাকে পাঁচ দিন ধরে এই হাসপাতালে রেখেছি। ওয়ার্ড পরিষ্কার করার জন্য কেউ আসে না। তাই নিজেরাই ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করি। এখানে এসে দুর্গন্ধে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’
হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষের সামনে গিয়ে দেখা যায়- দেওয়ালের টাইলস খসে পড়ছে। সামনের কক্ষের দরজার হাতলও ভেঙে গেছে। এছাড়াও দরজার কাঠের জোড়ার অংশ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে আসা রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘যে ভবনের পরিচালকের কক্ষের সামনের টাইলস খুলে পড়ছে সেখানে পুরো ভবন কি পরিমাণ টেকসই সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।’
শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা পুরোপুরি চালু করতে পর্যাপ্ত জনবলের প্রয়োজন। জনবলের জন্য বারবার মন্ত্রণালেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জনবল পেলেই পুরোপুরি স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।’
শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালনা পরিষদের সহ-সভাপতি সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সবই আছে। কিন্তু জনবলের কারণে পুরোপুরি হাসপাতালটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালের সভাপতি কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক সভা করার পর আর কোনো সভা এখনও হয়নি। দায়িত্বে যারা ছিলো, তারা কেউ দায়িত্ব পালন করেননি। এসব কারণে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা পুরোপুরি চালু হয়নি।’