সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিকাশে দেশ এগিয়ে যায়। রাজস্ব আয়ের চেয়ে রাজস্ব ব্যয় যথারীতি কম হলেও উন্নয়ন ব্যয়ের কারণে বাজেটে ঘাটতি হয়। এ সমীকরণে ঘাটতি দূর করার উপায় দুটি। এক. রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, অথবা দুই. উন্নয়ন বাজেটে ব্যয় কমানো।
রাজস্ব ব্যয় দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় একই থাকে বলে পরিবর্তনের সুযোগ অনেক কম। অন্যদিকে, উন্নয়ন ব্যয় দীর্ঘমেয়াদে একটি দেশের এগিয়ে চলার মূল চালনা শক্তি। সে প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে ঘাটতি কমানোর যথেষ্ট যুক্তি নেই। তাই রাজস্ব আহরণ ব্যতীত ঘাটতি মোকাবিলার যথেষ্ট সুযোগ নেই। তবে উন্নয়ন বাজেটকে অধিক দক্ষ ও কার্যকর করার মাধ্যমে সার্বিকভাবে বাজেট প্রণয়নে দক্ষতা অর্জন করা যেতে পারে। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের যে কৌশল রয়েছে তা প্রতিপালন করার মাধ্যমে সরকারি উন্নয়ন বাজেট অধিকতর কার্যকর হতে পারে। আর সে কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারি উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে নিট প্রেজেন্ট ভ্যালু, ইন্টারনাল রেইট অফ রিটার্ন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়।
ঘাটতি বাজেট মানেই খারাপ- এ ধারণা অমূলক। একজন বিনিয়োগকারী যদি ৫ টাকা সুদে ১০০ টাকা ঋণ করে বছর শেষে ১০৬ টাকা আয় করেন তবেই ঋণ নেয়া যৌক্তিক। ঠিক এ যুক্তিতেই সরকার যে সুদ হারে ঋণ নেবে তার চেয়ে যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশি হয় তবে ঋণ নেয়া যেতেই পারে। এ কারণেই বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে কম সুদে ঋণ নিতে সরকার স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। মাথায় রাখতে হবে রাজস্ব ব্যয় হতে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। যদি অধিক সুদে ঋণ নেয়ার ফলে কিংবা ঋণের অর্থের বিপরীতে আয় বেশি না হওয়ার কারণে পরবর্তী বছরে তা পরিশোধ করতে গিয়ে আবারও ঋণ করতে হয় তবে একটি দেশ ক্রমশ ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে যায় যা ঐ অর্থনীতির জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। অর্থনীতির ইতিহাসে বহু দেশ এরকম অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ গ্রিসের কথা বলা যায়।
বাজেট ঘাটতি কম রাখার সবচেয়ে বড় কৌশল হলো রাজস্ব আয় বৃদ্ধি। সরকারের রাজস্ব আয় দুভাবে আসতে পারে। কর ও কর-বহির্ভূত উৎস হতে। করের দুটি উৎস: ক. প্রত্যক্ষ কর ও খ. পরোক্ষ কর। প্রত্যক্ষ করের মধ্যে রয়েছে ব্যক্তি পর্যায়ের আয়কর, কর্পোরেট কর, ব্যাংকের অতিরিক্ত লভ্যাংশ, সম্পদের উপর কর, ট্র্যাভেল ট্যাক্স ইত্যাদি। পরোক্ষ করের আওতা বেশ বড় যেখানে মূল্য সংযোজন কর (স্থানীয় ও আমদানি পর্যায়ে), সম্পূরক শুল্ক (স্থানীয় ও আমদানি পর্যায়ে), আমদানি শুল্ক, রপ্তানি শুল্ক ইত্যাদি রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো কর-জিডিপি অনুপাত অনেক কম। আমাদের জন্য এ অনুপাত ৯ শতাংশের মতো যা পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে কম। কর-জিডিপি অনুপাত ভারতে ১৯ শতাংশ, কম্বোডিয়ায় ২৪ শতাংশ, লাওসে ১৫ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ২০ শতাংশ, নেপালে ২২ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ১৮.৫ শতাংশ। এর মধ্যে আমাদের পরোক্ষ করের উপর নির্ভরশীলতা বেশি। মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় ৬৬ শতাংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে এবং পরোক্ষ করের একটি বড় অংশ আসে ভ্যাট থেকে।
প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ করের মূল পার্থক্যের জায়গা হলো প্রত্যক্ষ করের বোঝা (burden) অন্যের উপর স্থানান্তর/পরিবর্তন করা যায় না। অন্তত ৫টি কারণে আমাদের প্রত্যক্ষ কর বিশেষ করে, আয়করের উপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে। প্রথমত, কর আরোপের মাধ্যমে সরকার তার আয় করে। যে কোনো কর প্রাপ্তি সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ায় যা বাজেট ঘাটতি কমাতে সাহায্য করে।
দ্বিতীয়ত, সমাজে আয় বৈষম্য কমিয়ে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে প্রত্যক্ষ করের বিকল্প নাই। এখানে দুটি বিষয়ের অবতারণা করা যায়। এক. সরকারের রাজস্ব নীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো সমাজের বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য কমানো। আর এ কারণে প্রগ্রেসিভ রেইটে আয়কর আরোপ করা হয়। ধরা যাক, দুই ব্যক্তির একজনের আয় ১০০ টাকা এবং অন্যজনের ১০০০ টাকা। যদি ১০ শতাংশ হারে কর আদায় করা হয় তাহলে ১০০ টাকা আয়ের ব্যক্তি অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কর আদায়ের দর্শন হলো যে পরিমাণ কর আদায় করা হবে তা উল্লিখিত দুই ব্যক্তির জন্য সমান ক্ষতি তৈরি করবে। সে জন্য বেশি আয়ের মানুষের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করা হয়ে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট আয় পর্যন্ত করমুক্ত আয়সীমা নির্ধারণ করা হয়।
দুই. পরোক্ষ কর মূলত সমাজে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, লবণ কিনে স্বল্প আয়ের (ধরি, মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকা) একজন মানুষ যে পরিমাণ ভ্যাট দিচ্ছেন বেশি আয়ের (ধরি, মাসিক আয় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা) একজন ঠিক একই সমান ভ্যাট দিচ্ছেন যা সরকারের রাজস্ব নীতি উদ্দেশ্যের বিপরীত। বিভিন্ন দেশের প্রত্যক্ষ কর ও আয় বৈষম্যের (‘জিনি সহগ’ দিয়ে পরিমাপ করা যায়) সম্পর্ক বিশ্লেষণে দেখা যায়, যে দেশের প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ বেশি সে দেশের জিনি সহগের মান কম। উদাহরণস্বরূপ, ডেনমার্ক। প্রসঙ্গত, জিনি সহগের মান বেশি মানে আয় বৈষম্য বেশি। তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে আয়করের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
তৃতীয়ত, ধরা যাক সমান আয়ের দুজন মানুষ রয়েছেন যার মধ্যে একজন আয়কর দিচ্ছেন এবং অন্যজন দিচ্ছেন না। বিষয়টি সম্পূর্ণ নৈতিকতা বিরোধী। বাংলাদেশে আনুমানিক ৮৭ লাখ মানুষের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার রয়েছে যা সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার জন্যও নেয়া হয়ে থাকতে পারে। দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি বিবেচনায় এ হার ৫.১২ শতাংশ। ৮৭ লাখের মধ্যে ২৯ লাখ লোক আয়কর দিচ্ছেন যা মোট জনসংখ্যার ১.৭ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জন্য এ সংখ্যা ৫ শতাংশের মতো। মজার বিষয় হচ্ছে, এর একটি বড় অংশ হচ্ছেন যাদের বেতন বা আয় একটি ফরমাল চ্যানেলে লিপিবদ্ধ থাকে। যেমন, সরকারি চাকুরিজীবী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, বিভিন্ন এনজিও বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লোকজন, ইত্যাদি। তবে এদের রেকর্ডেড আয়ের বাইরে অন্য আয় থাকলে তা নির্ণয় করাও কষ্টকর হবে। দেখা যাচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজারে যারা অন্তর্ভুক্ত তাদের আয়ের হিসাব করা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজারে পুরুষ ও মহিলাদের অংশগ্রহণ যথাক্রমে ৯৫ ও ৯৭ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে যে কোনো পুরুষ মানুষের আয় বাৎসরিক ৩ লাখ টাকা হলেই তাকে আয়কর দিতে হবে। নারী, প্রতিবন্ধী ও যুদ্ধাহত গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধাগণের ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণে অতিরিক্ত ছাড় রয়েছে। একজন ৩ লাখ (মাসিক ২৫ হাজার টাকা) টাকা আয় করে আয়কর দিচ্ছেন, অন্যজন এর চেয়ে বেশি টাকা আয় করে এড়িয়ে যাচ্ছেন – বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা মজুরিভিত্তিতে কাজ করেন এরকম অনেকেই রয়েছেন যারা মাসিক ২৫ হাজার টাকা আয় করেন। যদি এরকম হয় যে তাদের কাছ থেকে আয়কর সংগ্রহ করলে তাদের জীবনধারণ কষ্টকর হতে পারে তবে সে ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো যেতে পারে। তবে যারা আয়কর প্রদানের যোগ্যতা রাখেন তাদের আয়কর দেয়ার মানসিকতায় আসতেই হবে।
যে বিষয়ে আজকের এ লেখা তার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে ৩ লাখ টাকা আয় করা পুরুষ লোকের সংখ্যা কত হতে পারে? গবেষকগণ সম্ভাব্য সংখ্যা নিয়ে কাজ করতে পারেন। সচেতন পাঠকগণ কি বলবেন যারা করযোগ্য আয় করছেন কিন্তু আয়কর দিচ্ছেন না তাদের সংখ্যা কত হতে পারে? আমার তো মনে হয় অর্থনীতির এ যুগান্তকারী উত্থানে উপজেলা পর্যায়েও অনেক লোক পাওয়া যাবে যারা ব্যক্তি পর্যায়ের আয়কর দেয়ার সামর্থ্য রাখেন। আশার বিষয় হচ্ছে, পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ রিটার্ন দাখিলের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
চতুর্থত, অনেকেই বলে থাকেন সবাই পরোক্ষ কর বা ভ্যাট দিচ্ছেন। কথা সত্যি, আমরা সবাই কম-বেশি ভ্যাট দিচ্ছি। যিনি বেশি ব্যয় (ভোগ ও বিনিয়োগ) করছেন তার পরোক্ষ করও বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেউ কি বলতে পারবেন যে কত টাকার ভ্যাট দিয়েছেন? ফলে পরোক্ষ করের হিসাব পরোক্ষভাবেই লিপিবদ্ধ হচ্ছে।
পঞ্চমত, সরকারের রাজস্ব আদায়ের সাথে সামষ্টিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি সরাসরি সম্পর্কিত। বর্তমান বিশ্বের উন্নয়ন অর্থনীতির দর্শনের সাথেও রাজস্ব আদায় যুক্তিসঙ্গতভাবে সম্পর্কিত। এ লেখার শিরোনামের সাথে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের দুটি প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ের আয়কর বা কর্পোরেট কর সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দুইভাবে ভূমিকা রাখে। এক. বাজেট ঘাটতি কমিয়ে উন্নয়ন ব্যয়ে অবদান রাখতে এবং দুই. সরকারি সম্পদে নিজেদের অংশীদারিত্ব (ownership) সৃষ্টি করতে। দ্বিতীয় বিষয়টি ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
আয়কর প্রদানের মাধ্যমে একজন করদাতা সরকারি সম্পদের উপর তার অধিকার সংরক্ষণ করেন। এর পাশাপাশি সরকারের পক্ষেও তার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। একটি যুতসই উদাহরণ দেই। ধরা যাক, কোনো একটি এলাকায় সরকার তার নিজস্ব অর্থায়নে একটি নলকূপ স্থাপন করল। পাঠকগণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন- নলকূপটি কতদিন পর্যন্ত টিকে থাকবে? আমি সম্পূর্ণ ধারণা থেকে বলছি, ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে এটি আর কাজ করবে না। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা অকেজো হয়ে যাবে কিংবা লোকজন বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে যাবে। এমনকি পুরা নলকূপটিও গায়েব হয়ে যেতে পারে। যদি এমন না হয় তবে বিষয়টি অনেক আশাপ্রদ। তবে প্রশ্ন হচ্ছে– কেন এমন হবে? এর খুব সহজ উত্তর হচ্ছে, যারা এটি ব্যবহার করছেন তারা এটিকে নিজের সম্পদ মনে করছেন না। প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন আসবে, কেন তারা এটিকে নিজের সম্পদ মনে করছেন না? এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে তিনি সরকারকে আয়কর দিচ্ছেন না।
সরকারি এ নলকূপ যদি কোনো এনজিও স্থাপন করত তবে শুরুতেই স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক অবদান/ফি/টাকা আদায় করত যাতে এলাকাবাসীর ঐ নলকূপের উপর অংশীদারিত্ব সৃষ্টি হয়। অংশীদারিত্ব সৃষ্টি হওয়ার ফলে নলকূপের স্থায়িত্ব বেড়ে যাবে। কারণ আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় স্টেকহোল্ডারগণ নিজেদের স্বার্থে তা সচল রাখবেন। সম্পদ সৃষ্টিতে ব্যক্তি পর্যায়ের এ অবদানের ধারণা সরাসরি সামষ্টিকভাবে কাজে লাগান যায়। যেহেতু আমরা আয়কর দিচ্ছি না, সেহেতু সামগ্রিক অর্থনীতিতে সরকারি সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে উদাসীনতা দেখাচ্ছি। বিষয়টি খুবই সিম্পল– এর জন্য বড় মাপের অর্থনীতিবিদ হওয়া লাগে না। যদি জনগণ প্রত্যক্ষ কর দিয়ে সম্পদ সৃষ্টিতে অবদান রাখতেন তাহলে সরকারি সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ অনেক সহজ হতো। ব্যক্তি পর্যায়ের কর দেই না বলেই আমরা নেতিবাচকভাবে ‘সরকারি সম্পদ’ শব্দ দুটি ব্যবহার করি। ‘সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল’ জাতীয় অযাচিত বাক্য ব্যবহারেও আমরা দ্বিধা করি না।
আয়করের বাইরে প্রত্যক্ষ করের অংশ হিসেবে ১৫ হাজারের মতো লোক সম্পদের উপর কর এবং ৩০ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান কর দিয়ে থাকে। প্রশ্ন আসতে পারে, যাদের প্রত্যক্ষ কর দেওয়ার যোগ্যতা রয়েছে সরকার কেন তাদের কাছ থেকে কর আদায় করছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কোনো ব্যক্তি বৈধ পথে কত টাকা আয় করছেন তা মনিটর করা। অবৈধ পন্থায় আয় করলে সেটি বিবেচনা করা প্রায় অসম্ভব। এটি সত্যি, কর আদায়ে সরকারের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে, আয়কর ব্যবস্থাপনাকে উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। তবে মাথায় রাখতে হবে, কর আদায়ের সঙ্গে সরকারের রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির সম্পর্কও রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে সমাধান হচ্ছে প্রত্যেক মানুষের (individual) বিপরীতে ‘single account’ চালু করা যার মাধ্যমে সমস্ত লেনদেন পরিচালিত হবে। দিন শেষে সরকার জানবে কে কত টাকা আয় করছেন। বড় একটি প্রকল্প নিয়ে এনআইডির সঙ্গে সমন্বয় করে তা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রত্যক্ষ কর প্রদানে নিজেদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, সবাইকে আয়কর দেয়ার মানসিকতা পোষণ করতে হবে; যা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রীয় সম্পদের উপর আমাদের অংশীদারিত্ব বাড়াবে এবং একইসঙ্গে সরকারকে জনগণের নিকট অনেক বেশি ‘accountable’ করবে। বলতে দ্বিধা নেই, আমার উপর আরোপিত কর দেশের জনগণের আমানত; খেয়ানত করার সুযোগ নেই। পরোক্ষ কর কার্যত কোনো ধরনের অংশীদারিত্ব তৈরি করে না। ফলে প্রত্যক্ষ করের আওতা ও পরিমাণ বাড়ানো ব্যতীত উন্নয়নে জনগণের অংশীদারিত্ব বাড়ানো অসম্ভব। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও আমাদের অর্থনীতিতে মোট রাজস্ব আয়ের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে আসা আবশ্যক।
উন্নত দেশসমূহে মোট রাজস্ব আয়ের গড়ে ৩৫-৪০ ও ৬৫-৬০ শতাংশ আসে যথাক্রমে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর থেকে। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশসহ অনেক দেশের ক্ষেত্রে আরও বেশি। ভারতের ক্ষেত্রে মোট রাজস্ব আয়ের ৫১.৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ কর এবং ৪৮.৫ শতাংশ পরোক্ষ কর হতে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে পরোক্ষ করের অবদান মাত্র ১৭ শতাংশের মতো। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, উন্নয়ন পরিক্রমায় একটি দেশের এগিয়ে চলার সাথে সাথে তার পরোক্ষ করের উপর নির্ভরতা কমতে থাকে। আমরা ২০৪১ সালে যে ‘উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের কথা বলছি সেখানে আসীন হতে হলে প্রত্যক্ষ কর (ব্যক্তি পর্যায়ের আয়কর ও অন্যান্য) অন্তত ৪.৫ গুণ বৃদ্ধি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আয়কর বাড়িয়ে সরকারের আয় এবং উন্নয়নে জনগণের অংশীদারিত্ব বাড়ানোর মাধ্যমেই উন্নত বাংলাদেশ নির্মিত হবে, উন্নত বাংলাদেশ হলে আমাদের আয়কর বেড়ে যাবে– বিষয়টি এরকম নয়।
লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক